শিরোনাম: |
ট্রাম্প এখন মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য ফ্রাঙ্কেনস্টাইন
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
|
গত বুধবার ওয়াশিংটনে যে ঘটনাটা ঘটল, তা সাধারণত এশিয়া ও আফ্রিকার কোনো অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে ঘটে। কিন্তু এবার ঘটেছে সভ্য আমেরিকার সবচাইতে সভ্য শহর ওয়াশিংটনে। ঘটনাটা ঘটিয়েছেন স্বয়ং বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার অনুসারীরা লাঠি-বন্দুক নিয়ে কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটলে হামলা চালিয়েছে। তাদের হামলায় ভবনে ভাঙচুর হয়েছে। দেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এক যুক্ত বৈঠকে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জয়কে অনুমোদন জানাতে যাচ্ছিলেন। এ সময় এই হামলা। সুসভ্য আমেরিকার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা চেয়ার-টেবিলের তলায় প্রাণ বাঁচানোর জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন। অতঃপর রায়ট পুলিশের আগমন। তাদের গুলিতে চারজন ট্রাম্প সমর্থক হামলাকারীর মৃত্যু। ওয়াশিংটনে কারফিউ। বিশ্বময় নিন্দার ঝড়। অবশেষে ট্রাম্পের ঘোষণা, তিনি শান্তিপূর্ণভাবে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের কাছে ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
তার এই ঘোষণা বিশ্বাস করেন খুব কম লোক। তিনি আমেরিকান ভোটারদের অধিকাংশের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। সভ্যতাগর্বী আমেরিকার মাথা তিনি ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছেন। মার্কিন গণতন্ত্র তথা পশ্চিমা গণতন্ত্রের জন্য এটা একটা প্রচণ্ড আঘাত। আসলে বুধবার ওয়াশিংটনে কী ঘটেছে? এরকম ঘটনা ঘটেছে গত শতকের মধ্যভাগে ইতালিতে। ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি তার মাত্র কয়েকজন অনুচরসহ রোমে প্রবেশ করেন। পুলিশ দাঁড়িয়ে তা দেখেছে। কোনো বাধা দেয়নি। দুর্বল গণতান্ত্রিক শাসক ভিক্টর ইমানুয়েল মুসোলিনির কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং তার হাতে ক্ষমতা তুলে দেন। ট্রাম্পও হয়তো ভেবেছিলেন, নির্বাচনে পরাজিত হলেও তিনি বিশ শতকের মুসোলিনির কায়দায় একুশ শতকের আমেরিকায় ক্ষমতা নিজের হাতে রাখতে পারবেন। ওয়াশিংটনের পুলিশও ট্রাম্পের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক নিকোলাস ক্রিস্টফের মতে, 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' আন্দোলনের সময় শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রায় ওয়াশিংটনের পুলিশ যেভাবে শক্তি প্রয়োগ করেছে, ট্রাম্পের হামলাকারী দাঙ্গাকারী সমর্থকদের দমনে তারা তা প্রয়োগ করেনি। দাঙ্গাকারীদের হামলায় কংগ্রেস সদস্যদের যখন জীবনহানির আশঙ্কা দেখা দেয়, তখন তারা গুলিবর্ষণ করে। ট্রাম্পের ডাকে তার শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী সমর্থকরা ওয়াশিংটনে সমবেত হয়। তিনি তাদের সামনে উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেওয়ার পরই এই দাঙ্গা শুরু হয়। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদকের ভাষায়, এটা ক্যু ঘটিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা। নির্বাচনের ফল পাল্টানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি সামরিক আইন জারি করার কথাও ভেবেছিলেন। কিন্তু কোনো মহল থেকেই তিনি এর সমর্থন পাননি। ভাবতে অবাক লাগে, যে আমেরিকা আফ্রো-এশিয়ার সদ্য স্বাধীন দেশগুলোতে তাদের সদ্য অর্পিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উৎখাত করেছে, গণতান্ত্রিক নেতাদের হত্যা করে সেখানে মিনিস্টারি জেনারেলদের 'লৌহমানব' আখ্যা দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে, সেই আমেরিকার রাজধানীতেই আজ তাদের সংসদ ভবন এবং নির্বাচিত সদস্যরা ট্রাম্পের সমর্থক বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গদের হাতে আক্রান্ত হচ্ছেন। পুলিশের গুলিতে দাঙ্গাকারী মরছে। রাজধানীতে কারফিউ দিতে হয়েছে। এ যেন সাবেক তৃতীয় বিশ্বের কোনো অনগ্রসর দেশের ঘটনা। মাইক গ্যালাঘার উইসকনসিনের এক রিপাবলিকান প্রতিনিধি। তিনিও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, আমেরিকা এখন একটি 'পাগলা রিপাবলিক'। ট্রাম্প শুধু একটি ভবনের ওপর হামলা চালাননি, তিনি আমেরিকার সংবিধান, নির্বাচন পদ্ধতি এবং তার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপরও হামলা চালিয়েছেন। তিনি আমেরিকার সম্মান ধুলায় লুটিয়েছেন। আমেরিকার শত্রুরা এখন আমেরিকাকে নিয়ে হাসছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেন বিপুল ভোটে জিতেছেন। এই জেতার বিরুদ্ধে মামলা করে ট্রাম্প সুপ্রিম কোর্টেও হেরেছেন। তার পরও তিনি পরাজয় স্বীকার করেননি, বরং অকল্পনীয় ঘটনা ঘটিয়েছেন। একটি সিভিল ক্যু দ্বারা অর্থাৎ তার সমর্থকদের দ্বারা একটি ভয়াবহ দাঙ্গা বাধিয়ে তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছেন। তার এই উদ্দেশ্য সম্পর্কে মার্কিন পত্রপত্রিকাতেই এখন চাঞ্চল্যকর খবর বেরোচ্ছে। এই হাঙ্গামা বাধিয়ে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি অস্থিতিশীল করে তিনি বাইরেও একটা বড় ক্রাইসিস সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। এ জন্য তিনি ইরানে আকস্মিকভাবে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিলেন। এই হামলা চালাতে পারলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে তিনি নিজের হাতে ক্ষমতা ধরে রাখবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু আমেরিকার সেনা নায়করা তার প্রস্তাবে রাজি হননি। তথাপি তিনি ইরানে হামলা চালানোর ইচ্ছেটা যে ত্যাগ করেছেন তা নয়। তিনি সুযোগের অপেক্ষা করছেন। এখনও তার হাতে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় রয়েছে। ইরান ট্রাম্পের এই অসৎ উদ্দেশ্যের কথা জানে। তাই বোমা হামলা প্রতিরোধের জন্য ইরান সর্বোচ্চ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। আমেরিকার জনগণও এই নতুন যুদ্ধ সম্প্রসারণের বিরোধী। তিনি হঠাৎ হঠকারিতার বশে কোনো হামলা চালাতে চাইলেও শুধু আমেরিকার মানুষ নয়, বিশ্ববাসীও তাকে প্রতিহত করবে। ট্রাম্প এখন এ কথা জানেন। তার গত বুধবারের চক্রান্তটিও ব্যর্থ হওয়ায় তিনি এখন বলছেন, ২০ জানুয়ারি তিনি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। তার এ কথা কেউ বিশ্বাস করে না, সে কথা আগেই বলেছি। ট্রাম্প যাতে ফেসবুক অথবা টুইটারে উস্কানিমূলক বক্তব্য ছড়াতে না পারেন, সেজন্য তার ব্যবস্থা হয়েছে। জো বাইডেনের নির্বাচন-বিজয়কে সিনেট ও কংগ্রেস সদস্যরা যুক্তভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বিশ্বনেতৃবৃন্দও ট্রাম্পের অবিমৃশ্যকারিতার নিন্দা করেছেন। তাতে আশা করা যায় ২০ জানুয়ারি হোয়াইট হাউসে জো বাইডেনের প্রবেশে বড় কোনো বাধা থাকবে না। প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ট্রাম্প সরে গেলে ট্রাম্প ইজমের ভূত আমেরিকাকে সহজে ছাড়বে তা বিশ্বাস না করাই ভালো। হিটলার গত শতকে জার্মানির তরুণ প্রজন্মকে শিখিয়েছিলেন, জার্মান জাতিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি। পৃথিবীকে শাসন করার অধিকার একমাত্র তাদের। ইহুদিরা হচ্ছে জার্মান জাতির শত্রু। ফ্যাসিবাদের এই মন্ত্রে তরুণ প্রজন্মের এক বিরাট অংশকে প্রভাবিত করে হিটলার ক্ষমতায় এসেছিলেন। মুসোলিনি ইতালির তরুণদের বলেছেন, তিনি প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করবেন। তিনি নতুন সিজার। তার নেতৃত্ব মানলে ইতালির মানুষ হবে অতীতের গর্বিত রোমান। তিনি কীভাবে ক্ষমতায় এসেছেন সে কথা আগেই বলেছি। ট্রাম্পের মতো, তারাও প্রথমে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন। তারপর নির্বাচন ব্যবস্থা তুলে ক্ষমতায় বন্দুকের জোরে বসে রয়েছেন পতনের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত। ডোনাল্ড ট্রাম্পও হিটলার-মুসোলিনির কায়দায় প্রথমে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন। তিনিও শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের এক বৃহৎ অংশের মধ্যে 'আমেরিকা ফার্স্ট' এই ফ্যাসিবাদী ধুয়া তুলে এবং বহিরাগতদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে প্রথমে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসেছেন। তারপর হয়তো ফ্যাসিবাদী কায়দায় দেশের সংবিধান, সংসদ, নির্বাচন প্রক্রিয়া, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি সব কিছু অগ্রাহ্য করে ক্ষমতা স্থায়ীভাবে কুক্ষিগত করবেন ভেবেছিলেন। এই চেষ্টা আপাতত ব্যর্থ হলেও তিনি ও শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীরা সহজে নতুন চক্রান্ত করা থেকে নিবৃত্ত হবেন না। তাদের সংখ্যা-শক্তি কম নয়। ট্রাম্প পরাজিত হলেও তার পক্ষে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায় তার পেছনে সমর্থন কম নয়। প্রেসিডেন্ট পদে বসেই জো বাইডেন ও ডেমোক্রেটিক দল যদি পুরোনো প্যাটার্নেই দেশ শাসন শুরু করেন এবং দেশের রাজনীতিতে ট্রাম্পইজম তথা ফ্যাসিবাদের প্রভাব বিস্তার রুখে না দেন, তাহলে আমেরিকান গণতন্ত্র তথা পাশ্চাত্য গণতন্ত্র সহসাই আবার আক্রমণের সম্মুখীন হবে। এই আক্রমণ নির্বাচন-পদ্ধতির মাধ্যমে না এসে অন্য কোনো পদ্ধতির মাধ্যমেও আসতে পারে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিপর্যয়ের পর গণতান্ত্রিক বিশ্বেও যদি বিপর্যয় নেমে আসে তাহলে মানবতা ও মানবসভ্যতা দুই-ই বিপন্ন হবে। |