শিরোনাম: |
বাংলাদেশে বামদের বামদশা কেন
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
|
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি এবং বর্তমান উপদেষ্টা কমরেড মনজুরুল আহসান খানকে সম্প্রতি দল থেকে ছয় মাসের জন্য অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তার অপরাধ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর নিয়ে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় আলোচনা করতে গিয়ে তিনি হাসিনা সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেছেন।
আমি সিপিবির এই আওয়ামী ফোবিয়া নিয়ে ঢাকার একটি দৈনিকে সম্প্রতি আলোচনা করেছিলাম। তাতে সিপিবির এক সমর্থক (সদস্য কিনা জানি না) শ্রী সুধাংশুকুমার দাশ ঢাকা থেকে আমাকে ইন্টারনেট বার্তায় জানিয়েছেন, আমি সিপিবিকে সমালোচনা করে মহা ভুল করেছি। তার মতে, দেশকে সুশাসনদানে, বিশেষ করে সংখ্যালঘু নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষায় আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে এবং বিএনপি আমলের মতো দুর্নীতির বিস্তার ঘটাচ্ছে। এখন কমিউনিস্ট পার্টিই দেশের একমাত্র আশা ও ভরসা। আমি সিপিবিকে সমালোচনা করে সঠিক কাজ করিনি। আমি সুধাংশু বাবুর প্রথম অভিযোগ সম্পর্কে কোনো জবাব দিতে চাই না। কারণ দেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে আওয়ামী শাসন কেন অপরিহার্য, তা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়েও বহু আলোচনা করেছি। তা নিয়ে নতুন করে আলোচনা নিরর্থক। তবে সুধাংশু বাবুর দ্বিতীয় বক্তব্য, বর্তমানে সিপিবিই দেশের একমাত্র আশা-ভরসা কি না, তা নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাই। এ কথা সত্য, শুধু অবিভক্ত বাংলাদেশে নয়, অবিভক্ত ভারতবর্ষে একসময় অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ছিল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পর উপমহাদেশের তৃতীয় শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। ভারতের ছাত্র ও শ্রমিকশ্রেণির ওপর ছিল তাদের বিরাট প্রভাব। অবিভক্ত ভারতের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সংখ্যাগরিষ্ঠ বিরাট অংশ ছিল তাদের সমর্থক। পশ্চিমবঙ্গে গোপাল হালদার, আবু সাইয়িদ আইয়ুবের মতো বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি এত বড় দল হয়েও কখনো সঠিক সময়ে সঠিক কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। ১৯৪২ সালে কংগ্রেসের ব্রিটিশবিরোধী কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলনের বিরোধিতা করে কমিউনিস্ট পার্টি ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা দেয় এবং ভারতের জনগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়। আবার ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে স্বাধীন হওয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টি স্লোগান দেয়, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’। এই স্লোগান দিয়ে শ্রেণিসংগ্রামের নামে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহনের যে ভাস্কর্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে, তা ভাঙতে শুরু করে। বলা হয়, এরা বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রতীক। ভাস্কর্য ভাঙার রাজনীতি উপমহাদেশে কমিউনিস্টরাই প্রথম শুরু করে। সন্ত্রাসের রাজনীতিও তারাই প্রবর্তন করে শ্রেণিসংগ্রামের নামে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি ছিল ছাত্র, শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় দল। তত্কালীন মুসলিম লীগ সরকার দলটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সত্ত্বেও দল জনপ্রিয়তা হারায়নি। রাশিয়া ও চীনের তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে জড়িত হয়ে কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়ে মস্কোপন্থি অংশ সিপিপি (কমিউনিস্ট পার্টি অব পাকিস্তান) হওয়ার পরে ছাত্র, শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনের সময় সিপিপির বুদ্ধিভ্রংশ হয় এবং তারা ছয় দফাকে ‘সিআইএর তৈরি দলিল’ আখ্যা দিয়ে বাঙালির এই জাতীয় আন্দোলনের বিরোধিতা করে। তাদের জনপ্রিয়তা ধসের মুখে পড়ে। সম্ভবত সিপিপি পরে নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। তাদের ছাত্রসংগঠনের দ্বারা ১১ দফা তৈরি হয় এবং ৬ দফা ও ১১ দফার যুক্ত আন্দোলন শুরু হয়। এই সময় থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত সিপিপি নাম পরিবর্তন করে সিপিবি (কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ) হয় এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ নেয়। এমনকি স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কাজ করার জন্য বাকশালে অঙ্গীভূত হয়। কমিউনিস্ট নেতারাই কার্যত কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব বিলুপ্ত করেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর কমিউনিস্ট পার্টি আবার ভোল পালটায় এবং সামরিক অভ্যুত্থানের নেতা জিয়াউর রহমানকে সমর্থন দেয়। জিয়াউর রহমানের খাল কাটার পরিকল্পনায় যোগ দেন তারা। দেশে রাজনীতি চর্চার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে সিপিবির সহযোগী দল মুজাফ্ফর ন্যাপ প্রথম বাকশাল ভেঙে বেরিয়ে আসে এবং জিয়াউর রহমানের দরখাস্তের রাজনীতিতে অংশ নেয়। ধীরে ধীরে সিপিবি শুরু করে আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতি। বিএনপি-জামায়াতের অপশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সব বামপন্থি গণতান্ত্রিক দল মিলে মহাজোট গঠিত হলেও সিপিবি এই মহাজোটে যোগ দেয়নি বরং দলে আওয়ামী লীগবিরোধিতা দিনের পর দিন বেড়েছে। সাম্প্রতিক কালে তা আওয়ামী বিদ্বেষে পরিণত হয়েছে। তার প্রমাণ, দলের সাবেক সভাপতি রাজনৈতিক সৌজন্য দেখিয়ে শেখ হাসিনার শাসনামলের প্রশংসা করায় দল তা সহ্য করতে পারেনি। এক দলের নেতার অপর বিরোধী দলের নেতার প্রশংসা করার নজির ভূরিভূরি আছে, তাতে কোনো দল কখনো নিজেদের নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সিপিবি করেছে। যদিও বাংলাদেশের রাজীতিতে তারা আজ খুবই দুর্বল এবং তারা খুবই ছোট দল। সিপিবির আওয়ামী বিদ্বেষের পেছনে যে প্রচণ্ড হাসিনাবিদ্বেষ লুকিয়ে আছে, তার প্রমাণও পাওয়া গেছে। দলটির এই অরাজনৈতিক বিদ্বেষের দরুন দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষতি হয়েছে। তা কোনো ভালো ফল দেয়নি। দেশে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার ও শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থন ও সহযোগিতাতেই একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয় এবং শেখ হাসিনার মনোনয়নেই শহিদজননী জাহানারা ইমাম এই আন্দোলনের নেতা হন। আওয়ামী লীগের সমর্থনলাভের ফলে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি জনপ্রিয় বিরাট সংগঠন হয়ে ওঠে এবং জাহানারা ইমামও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে মস্কোপন্থি ও চীনপন্থি দুই গ্রুপের কমিউনিস্ট দলই একটি গোপন খেলায় মেতে ওঠে। তারা নিজেরা কখনো হাসিনার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন না—এটা জেনে তারা জাহানারা ইমামকে শেখ হাসিনার বিকল্প নেতা হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা শুরু করেন। তাদের এই গোপন তত্পরতা যখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চোখে ধরা পড়ে, তখন তারা ধীরে ধীরে এই সংগঠন দূরে সরাতে থাকেন। ফলে নির্মূল কমিটি এখনো আছে, কিন্তু তার আগের জনপ্রিয়তা আর ধরে রাখা যায়নি। শহিদজননী জাহানারা ইমাম এই খেলা প্রথমে বুঝতে পারেননি। যখন বুঝতে পারেন তখন নিজে ক্যানসারে জর্জরিত। তবু দলের শুভানুধ্যায়ীদের কাছে চিঠি লিখে তিনি এই ষড়যন্ত্রের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন। সিপিবির নেতারা একই খেলা খেলেছেন শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হওয়ার পর। মঞ্চ এত শক্তিশালী হওয়ার কারণই ছিল ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সমর্থনলাভ। মঞ্চের নেতা হিসেবে আবির্ভূত ইমরানও প্রথমে ছিলেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত। সিপিবির নেতারা এই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে প্রথম থেকেই কৌশলে নিরপেক্ষতার নামে আওয়ামী লীগের নেতাদের এই মঞ্চ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন এবং ইমরানের মনে ভবিষ্যত্ বাংলার ‘দ্বিতীয় শেখ’ হওয়ার স্বপ্ন ছাপিয়ে তোলেন বলে আমার ধারণা। আমি সিপিবির এই কৌশল সম্পর্কে ইমরানকে সাবধান করেছিলাম। সিপিবির নেতাদের এই কৌশলের রাজনীতি দেশে গণ-আন্দোলন ও গণরাজনীতির কোনো উপকারে আসেনি, বরং তাতে পরস্পরের মনে পরস্পর সম্পর্কে সন্দেহ ঢুকিয়েছে। বিভেদ সৃষ্টি করেছে। তাতে লাভবান হয়েছে গণবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল জোট। বাংলাদেশে আজ বাম রাজনীতির এই বামদশা, তার কারণ কমিউনিস্ট দলের দুই অংশের এই বিভ্রান্তি ও ক্ষতিকর রাজনৈতিক পথচলা। তারা দেশে এখনই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। চীন বিপ্লবের সময় একটি কৃষিভিত্তিক দেশ থাকায় মাও জে দুং সমাজতন্ত্র থেকে পিছিয়ে নিউ ডেমোক্রেসি বা নয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজ সেই নয়া গণতন্ত্রও পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি গ্রহণ করেছে। সোভিয়েট ইউনিয়নের তো অস্তিত্বই নেই। আমার সন্দেহ নেই, কমিউনিস্টরা বিশ্বের সব দেশে জনহৈতিষী ও জনগণের কল্যাণ করার দল। এই দলের নেতারা যখন ক্রমাগত ভুলের বালুচরে পা রেখে রাজনীতি করেন, তখন আমাদের মতো তাদের হিতৈষীরা দুঃখ পাওয়া ছাড়া আর কী করতে পারে? বামদের বর্তমান বামদশার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। |