শুক্রবার, ২৯ মার্চ, 2০২4
মহামারী আকার ধারণ করবে ডেঙ্গু
Published : Tuesday, 25 June, 2019 at 8:47 PM

স্টাফ রিপোর্টার॥
ঢাকার এক দৈনিকের চনমনে তরুণ সংবাদকর্মী আশিক এখন লাইফ সাপোর্টে। এই লেখা ছাপা হতে হতে তাঁর কী অবস্থা হবে, জানা নেই। মা তাঁর বরগুনায় অপেক্ষায় আছেন ভালো খবরের আশায়। সবার সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ি গিয়েছিলেন আশিক। যাওয়ার আগে জ্বর জ্বর ভাব থাকলেও কাজের চাপে সেদিকে নজর দেননি। বরগুনায় যাওয়ার পর জ্বর তাঁকে জাপটে ধরে, ভাবেননি ডেঙ্গু তাঁকে তাড়া করে ফিরছে। স্থানীয় চিকিৎসকেরাও বোধ করি সাধারণ জ্বরই ধরে নিয়েছিলেন। প্যারাসিটামল ব্যর্থ হলে অ্যান্টিবায়োটিকের যাত্রা শুরু হয় এ দেশে, পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রা বাড়তে থাকে। আশিক হয়তো চিকিৎসার এই সনাতন প্রক্রিয়ার ফাঁদে পড়ে এখন জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অনেকের পাতলা পায়খানা হয়, আশিকের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় হয়নি। ঢাকায় ফিরে তিনি ডায়রিয়ার চিকিৎসা নিতে ভর্তি হন কলেরা হাসপাতালে। অবস্থা খারাপের দিকে যাওয়ায় সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রিন রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে, শরীরে ১০ ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পরেও শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় এখন সেখানকার নিবিড় পরিচর্যায় তাঁর ঠাঁই হয়েছে। গত তিন দিনে অবস্থার কোনো রকমফের হয়নি। চিকিৎসকেরা বলছেন, তাঁর কিডনি, ফুসফুস আর লিভার এখন আক্রান্ত। ডেঙ্গুর এ এক চরম চেহারা।
গত ২৪ এপ্রিল মারাত্মক চেহারায় ডেঙ্গু আবির্ভাবের শঙ্কা প্রকাশ করে দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষগুলোকে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে ‘আগাম বৃষ্টি কি আনবে আগাম ডেঙ্গু?’ শীর্ষক একটি মতামত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। সে সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ বাংলাদেশের লাগোয়া রাজ্যগুলোতে ডেঙ্গুর আলামত স্পষ্ট হওয়ায় পরিস্থিতি মোকাবিলার নানা প্রস্তুতি চলছিল। আমরা পরিস্থিতির গুরুত্ব আমলে নিইনি। স্বাস্থ্য দপ্তরের সূত্রে জানা যাচ্ছে, গত এক মাসে হাসপাতালে শনাক্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। ঢাকা নগরীর সরকারি হাসপাতালগুলোতে মে মাসে যেখানে ডেঙ্গু রোগী ছিল ২৪৯ (এর মধ্যে ২ জন মারা যায়), সেখানে ১৭ জুনে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৫৮ জনে। প্রকৃতপক্ষে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে জানুয়ারি থেকে জুনের ৮ তারিখ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ২৯৫। পরের ১০ দিনে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৮ জনে। গত বছরের এই সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে এই সংখ্যা যথেষ্ট আশঙ্কার। উল্লেখ্য, গত বছরের প্রথম পাঁচ–ছয় মাসে সরকারি হাসপাতালে আসা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩৩। চিকিৎসকেরা মনে করেন, সরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর বাইরেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত আরও অনেক মানুষ রয়েছে, যারা হাসপাতালে ভর্তি হয় না।
সরকারি জরিপে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ আগের চেয়ে বেশি হওয়ার যথেষ্ট আলামত মিলেছে। বর্ষার আগে সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, ঢাকায় বাসাবাড়িতে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার জীবাণুবাহী এডিস মশা জন্মের হার আগের তুলনায় বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্যোগে পরিচালিত জরিপটি চলে ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের ৯৭টি ওয়ার্ডের ১০০টি জায়গায়। জরিপ বলছে, এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের সূচক ঢাকায় তখন ছিল ২২ শতাংশ। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ন্যূনতম মান অনুযায়ী ২০ শতাংশ এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে সেটাকে মহা বিপৎসংকেত গণ্য করে জরুরি কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বেশি ঝুঁকিতে আছে ঢাকা দক্ষিণ। সেখানকার ১৫টি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। তবে ঢাকা উত্তরের প্রধান সাতটি ওয়ার্ডেও এ ঘনত্ব নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।
তা ছাড়া যেসব দেশে আমরা হরহামেশা চিকিৎসা, কেনাকাটা বা বেড়াতে যাই, সেসব দেশ থেকে ফেরা যাত্রীদের সঙ্গে নতুন জাতের ডেঙ্গুর আবির্ভাব ঘটা বিচিত্র কিছু নয়। থাইল্যান্ডে গত পাঁচ মাসে ২৬ হাজার ৪৩০ জন ডেঙ্গুর মারাত্মক কবলে পড়েছে বলে সে দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানালে অনেক দেশ তাদের দেশের ভ্রমণকারীদের থাইল্যান্ডের ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়। আমাদের অবশ্য সেসবের বালাই নেই। থাইল্যান্ডে ইতিমধ্যেই ৪১ জন এই রোগে মারা গেছে। গত বছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ সে দেশে প্রায় দ্বিগুণ (১ দশমিক ৮ ভাগ)। অনেক চেষ্টা করেও থাই কর্তৃপক্ষ উত্তরের জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট চিয়াংমাইকে ডেঙ্গুমুক্ত রাখতে পারেনি। সেখানে পর্যটকের সংখ্যা কমেছে, কমেছে হোটেলের ভাড়া।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে গাপ্পি মাছের গল্প এখন পুরোনো। একসময় ঢাকঢোল পিটিয়ে দক্ষিণের পগারে ড্রেনে গাপ্পি মাছের পোনা ছাড়ার কথা বলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সেখানকার নগরপিতা। কারও বাসায় মশার ডিম পেলে তাকে দণ্ড দেওয়ার হম্বিতম্বিও শোনা গিয়েছিল একসময়। সব শেষ চমক ছিল এডিস মশা মারতে পুরুষ এডিস মশা আমদানির গালগল্প। ইন্টারনেটে যা দেখেন, তা–ই করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন আমাদের কল্পজগতে থাকা কর্তারা।
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমকর্মীরা ঢাকেশ্বরী মন্দিরের উল্টো পাশে ‘ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তর’ প্রতিষ্ঠানটির অফিসে গিয়ে তেমন কোনো তৎপরতার চিহ্ন খুঁজে পাননি। অফিসের অধিকাংশ কক্ষ ছিল তালা মারা, খোলা ছিল মাত্র দুটি। দোতলা ভবনের আশপাশে অনেক খালি ড্রাম তাঁরা ইতস্তত পড়ে থাকতে দেখেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা মারার জন্য যে ওষুধ কেনে, সেগুলো এখানে মজুত রাখা হয়। সংবাদকর্মীরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, মশা নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের তেমন কোনো কর্মসূচি বা গবেষণা কার্যক্রম নেই। দপ্তরের কাঠামো অনুসারে ৩৯৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার কথা। কিন্তু আছেন ২৭৭ জন। ১১৯টি পদ শূন্য রয়েছে। ১৯৪৮ সালে যখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে মশক নিবারণী দপ্তরটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এ প্রতিষ্ঠানের প্রধানের পদ ছিল সহকারী পরিচালক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন চিকিৎসক এ পদে দায়িত্ব পালন করতেন। পরে ১৯৮০ সালে দপ্তরটিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়া হয়। সেই থেকে এক জটিল সমীকরণের মধ্য দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যে উপসচিব এই দপ্তরের সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁর ভাষায়, ‘দপ্তরের প্রশাসনিক কার্যক্রম, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন–ভাতা দেওয়া ছাড়া দপ্তরের কর্মসূচি সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না, জানেন দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।’ দুই শাসনের চাকায় পিষ্ট প্রতিষ্ঠানটিতে আর যা–ই হোক জবাবদিহির পরিবেশ আছে বলে বিশ্বাস করা কঠিন।
গত বছর ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর জন্য মশা নিধনের পদক্ষেপ নিতে মেয়রদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। হয়তো জনস্বার্থে কেউ আবার আবেদন করলে হাইকোর্ট বড়জোর তাঁদের ডেকে পাঠাবেন, জানতে চাইবেন কী তাঁদের কর্মসূচি।
গাপ্পি মাছের গপ্প দিয়ে বুঝ দেওয়ার দিন কি এখনো আছে?
[চিকিৎসকেরা বলছেন, শরীরের তাপ বা জ্বর এক শ তিন/চার ডিগ্রি (ফারেনহাইট) উঠে গেলে, খুব মাথাব্যথা ও বমি বমি ভাব বা বমি হলে, গ্ল্যান্ড ফুলে গেলে, পেশিতে বা হাড়ের জোড়ায় ব্যথা করলে, গায়ে ঘামাচির মতো দানা দেখা গেলে, চোখের পেছনে ব্যথা করলে নিজে নিজে বা পাড়ার ডাক্তারকে সামান্য জানিয়ে চিকিৎসা শুরু করবেন না এবং উপযুক্ত চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ গ্রহণ করবেন না। যাঁরা দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবেন বা হয়েছেন, তাঁরা অবশ্যই চিকিৎসকের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে থাকবেন। প্রচুর পানি পান করবেন।]
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক



সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল হাজারী।   ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: গোলাম কিবরীয়া হাজারী বিটু্।   প্রকাশক: মোঃ ইব্রাহিম পাটোয়ারী।
সহ সম্পাদক- রুবেল হাসান: ০১৮৩২৯৯২৪১২।  বার্তা সম্পাদক : জসীম উদ্দিন : ০১৭২৪১২৭৫১৬।  সার্কুলেশন ম্যানেজার : আরিফ হোসেন জয়, মোবাইল ঃ ০১৮৪০০৯৮৫২১।  রিপোর্টার: ইফাত হোসেন চৌধুরী: ০১৬৭৭১৫০২৮৭।  রিপোর্টার: নাসির উদ্দিন হাজারী পিটু: ০১৯৭৮৭৬৯৭৪৭।  মফস্বল সম্পাদক: রাসেল: মোবা:০১৭১১০৩২২৪৭   প্রকাশক কর্তৃক ফ্ল্যাট নং- এস-১, জেএমসি টাওয়ার, বাড়ি নং-১৮, রোড নং-১৩ (নতুন), সোবহানবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং সিটি প্রেস, ইত্তেফাক ভবন, ১/আর কে মিশন রোড, ঢাকা-১২০৩ থেকে মুদ্রিত।  বার্তা, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ০২-৪১০২০০৬৪।  ই-মেইল : [email protected], web : www.hazarikapratidin.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি