বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, 2০২4
আইয়ুবের কৌশল কি এখন গণফোরামের রাজনীতিতে?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
Published : Tuesday, 5 November, 2019 at 8:55 PM

জেনারেল আইয়ুব খান যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তাহলে এই ভেবে আনন্দিত হতেন যে তাঁরা বাংলাদেশ হারিয়েছেন বটে, কিন্তু এখনো সে দেশটিতে তিনি তাঁর রাজনৈতিক কৌশলের অনুসারী একজনকে দেখতে পাচ্ছেন। মোনেম খাঁ, সবুর খাঁ এঁরা মারা গেছেন বটে; তাঁরা ছিলেন তাঁর হুকুম বরদার। কিন্তু এখন যাঁর মধ্যে তিনি তাঁর কৌশলের অনুসরণ দেখতে পাচ্ছেন, অতীতে তিনি তাঁর রাজনীতির বিরোধিতাকারী ছিলেন। এখন কেমন করে তাঁর চেঞ্জ অব হার্ট হলো এটা তিনি বুঝতে পারছেন না।
আইয়ুব আজ বেঁচে থাকলে কেন এমনটা ভাবতেন, তার কারণটা আগে পাঠকদের জানাই। ঢাকার কাগজে খবর দেখলাম, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সিলেট-২ (ওসমানীনগর-বিশ্বনাথ) আসনের সংসদ সদস্য, যুক্তরাজ্যপ্রবাসী রাজনীতিক ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী মোকাব্বির খানকে ড. কামাল হোসেন গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন। জিজ্ঞাসু পাঠক জিজ্ঞাসা করতে পারেন, ড. কামাল হোসেন মোকাব্বির খানকে তাঁর দলের নির্বাহী সভাপতি করায় তাঁর মধ্যে আমি আইয়ুবের পন্থা বা রাজনীতি অনুসরণের প্রমাণ পেলাম কোথায়? আমি এই প্রশ্নের জবাবে পরে আসছি। আগে মোকাব্বির খানকে অভিনন্দনটা জানাই। মোকাব্বির দীর্ঘকাল ধরে লন্ডনে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী এবং একই সঙ্গে গণফোরামের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন এবং আছেন।
আমার বিলাতে আসা অবধি তাঁর সঙ্গে পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা। মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ভালো এবং একজন নীতিনিষ্ঠ, কর্মনিষ্ঠ রাজনীতিক। আমাকে বিপদে-আপদে অনেকবার সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন মোকাব্বির। তাঁর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিবেষ্টিত রেস্টুরেন্টে বহুবার খেতে গেছি। ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে গেছি।
মোকাব্বির খানের রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্ক এখনো অচ্ছেদ্য। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরও তিনি আমার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ রাখেন। ড. কামালের এমন একনিষ্ঠ ভক্ত আমি আর দেখিনি। বিলাতে গণফোরামের কোনো পাত্তা নেই। এই পাত্তাটা শিবরাত্রির সলতের মতো বাঁচিয়ে রেখেছেন মোকাব্বির। এ জন্য তাঁকে আমি ঠাট্টা করে নাম দিয়েছি, বিলাতে ড. কামালের একমাত্র খলিফা।
এত কিছু সত্ত্বেও বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে তিনি একেবারেই অপরিচিত মুখ। তারপর থাকেনও বিলাতে। সিলেট-২ আসন থেকে তাঁর এবার নির্বাচিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। হয়েছেন আওয়ামী লীগের ভ্রান্তির জন্য। এখানে আওয়ামী লীগের যোগ্য মনোনয়ন প্রার্থী এবং আগের সংসদ সদস্য ছিলেন শফিক চৌধুরী। এরশাদের জাতীয় পার্টিকে খুশি করতে গিয়ে এই কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির এক সদস্যকে মনোনয়ন দেয়। ফলে মোকাব্বিরের ভাগ্য খুলে যায়। এই কেন্দ্রে তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ভোট পান এবং জিতে যান। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির সদস্যের জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়।
মোকাব্বির খানের ভাগ্যে এই অসম্ভব সম্ভব হওয়ার বড় কারণ ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ভোট পাওয়া। কারণ ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও মোকাব্বির বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি তাঁর আনুগত্য এবং সেই আদর্শ বস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়ার কথা তখনো বলেছেন, এখনো বলছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের একটি জাতীয় দলের নির্বাহী সভাপতি পদে তিনি এক লাফে বসে গেলেন কেমন করে? দলের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, ড. কামাল হোসেনের মনোনয়নে তিনি এই পদটি পেয়েছেন।
এখানেই প্রশ্নটি ওঠে, গণফোরামে কি এখন আর কোনো যোগ্য নেতা নেই, যার জন্য এক প্রবাসী সদ্য পরিচিত কর্মীকে এনে দলের নেতা পদে বসাতে হলো? গণফোরামের কি এমনই দেউলিয়া দশা হয়েছে? তা ছাড়া ড. কামাল হোসেন তো গণতন্ত্রের নামে পাগল। তাহলে দলের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচনে নির্বাহী সভাপতি না করে তিনি ব্যক্তিগত মনোনয়নে আর সব পরিচিত নেতাকে ডিঙিয়ে মোকাব্বিরকে নির্বাহী সভাপতি পদে বসাতে গেলেন কেন? রহস্যটা কী? মোকাব্বির গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি হয়েছেন, তাতে বিস্মিত হলেও আমি আনন্দিত। কিন্তু জানতে চাই এর পেছনের রহস্যটা কী?
প্রশ্নটা আমার মনে আরো বেশি করে জেগেছে এ জন্য যে মোকাব্বির খান ড. কামালের যতই একনিষ্ঠ ভক্ত হোন, এখন আর তিনি তো সম্ভবত নন, ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়নে নির্বাচনে জেতার পর ফ্রন্ট যখন সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের নির্বাচিত সদস্যরা সংসদে শপথ নেবেন না, মোকাব্বির খান সেই সিদ্ধান্ত এমনকি ড. কামাল হোসেনের দলীয় ও ব্যক্তিগত নির্দেশ অমান্য করে সংসদ সদস্য পদে শপথ নেন।
তাঁকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি ওঠে এবং এই ঘটনাকে ইস্যু করে দলের সেক্রেটারি মোস্তফা মহসিন হোসেন মন্টুকে পর্যন্ত ড. কামাল হোসেন হারান। শপথ গ্রহণের পর মোকাব্বির  খান ড. কামালের আশীর্বাদ চাইতে গেলে তিনি শুধু তাঁকে তাঁর বাসা থেকে বের করে দেননি, তাঁকে বলেছেন, ‘আপনি জীবনে আর আমার বাসায় আসবেন না।’ এ সময় মোকাব্বির খান লন্ডনে আমাকে টেলিফোন করলে তাঁকে আমি বলেছিলাম, ধৈর্য ধরুন, ড. কামালের সাধ্য নেই আপনাকে দল থেকে তাড়ায়। তাড়ালে তাঁর দলে শুধু সাইনবোর্ডটি অবশিষ্ট থাকবে। আমার সহৃদয় পাঠকরা দেখুন, গরিবের কথা ফলেছে কি না। কয়েক মাস না যেতে গণফোরামের সেই বিদেশে বসবাসকারী বিদ্রোহী কর্মী এখন দলের নির্বাহী সভাপতি। মনোনয়ন দিয়েছেন স্বয়ং কামাল হোসেন।
এখন জেনারেল আইয়ুবের কাহিনিতে আসি। পাকিস্তানে ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে আইয়ুবের পতন ঘটে। তখন বাংলাদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান। ক্ষমতায় বসে আইয়ুব মুসলিম লীগ দলটিকে বিভক্ত করে ফেলেন। নিজে হন দলের একাংশের সভাপতি। দলের নাম হয় কনভেনশন মুসলিম লীগ। বিভক্ত দলের অপর অংশের নাম হয় কাউন্সিল মুসলিম লীগ। এখন আইয়ুব  ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে তাঁর দলে ভাঙন ধরে। আইয়ুব  নিজেই চাইলেন দলটি ভেঙে দিতে। তবে নিজের হাতে নয়, এমন কৌশলে ভাঙবেন, যাতে তাঁকে হেয় হতে না হয়, তাঁর দুর্নাম না হয়।
চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন আইয়ুব খানের অনুসারী। তাঁকে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত করা হয়েছিল। কিন্তু যেকোনো কারণে হোক, আইয়ুব তাঁর প্রতি ক্রুদ্ধ হন এবং ফজলুল কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়। তিনি স্পিকারের পদ ছাড়তে বাধ্য হন।
ক্ষমতাহারা হয়ে ফজলুল কাদের চৌধুরী ঢাকার ইস্কাটনে ৯ নম্বর দিলু রোডের বাসভবনে বাস করতেন। আমি তাঁর রাজনীতির সমর্থক না হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন এবং চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলে আমার জন্য পতেঙ্গার তরমুজ, চট্টগ্রামের বোস ব্রাদার্সের মিষ্টি নিয়ে আসতেন। তাঁর মুখে এই কাহিনিটি আমার শোনা।
দুর্নীতি তদন্তকারী অফিসাররা যখন ফজলুল কাদের চৌধুরীকে খুব জ্বালাচ্ছিলেন, তখন আইয়ুব ক্ষমতায়। চৌধুরী সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি রাওয়ালপিন্ডি যাবেন এবং আইয়ুবের সঙ্গে দেখা করে একটা সমঝোতা করে ফেলবেন। আইয়ুব তাঁকে দেখা দিলেন; কিন্তু কিছু কথাবার্তার পরেই ক্রোধান্ধ কণ্ঠে বললেন, আপনি এই মুহূর্তে এই বাসা থেকে বেরিয়ে যান। জীবনে কখনো এই বাসায় আসবেন না।
ফজলুল কাদের চৌধুরী ভাঙা মনে ঢাকায় ফিরে আসেন। এরপর পাকিস্তানের রাজনীতি দ্রুত আবর্তিত হতে থাকে। ক্ষমতা থেকে আইয়ুবের পতন ঘটে। তিনি রাওয়ালপিন্ডি থেকে নবনির্মিত রাজধানী ইসলামাবাদে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। এই সময় হঠাৎ একদিন আইয়ুব টেলিফোন করলেন ফজলুল কাদের চৌধুরীকে। কারণ না জানিয়ে তাঁকে ইসলামাবাদে যাওয়ার জরুরি তলব দিলেন।
ফজলুল কাদের চৌধুরী যথাসময়ে ইসলামাবাদে গিয়ে পৌঁছলেন। আইয়ুব তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, জাতি আপনার নেতৃত্ব চায়। মুসলিম লীগ আমাদের হাতে কায়েদে আজমের আমানত। সেই আমানত রক্ষার ভার আপনার হাতে তুলে দিতে চাই। এখন থেকে আপনি হবেন মুসলিম (কনভেনশন) লীগের সভাপতি। আমি বড় ক্লান্ত। রিটায়ার করছি। আমার মনোনয়নে আপনি মুসলিম লীগের সভাপতি হবেন। জাতি তাই চায়।
ফজলুল কাদের চৌধুরী বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মুসলিম লীগের সভাপতি হওয়ার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে আমার চেয়ে যোগ্য লোক কি আর কেউ নেই? আইয়ুব জবাব দিয়েছেন, যোগ্য নেতা অবশ্যই আছেন। কিন্তু আপনার মতো কায়েদে আজমের যোগ্য অনুসারী নেই।
আইয়ুব কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি পদে ইস্তফা দিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, ১০ বছর জাতির অক্লান্ত সেবা করে তিনি ক্লান্ত। পাকিস্তান এবং কায়েদে আজমের স্বপ্ন হেফাজত করার জন্য একজন যোগ্য নেতা দরকার, সেই নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী। তিনি তাঁকেই কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি পদে মনোনয়ন দিয়েছেন।
এর পরের ঘটনা সবারই জানা। ফজলুল কাদের চৌধুরীর নেতৃত্ব পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর দলের কেউ মেনে নেয়নি। দলটি কিছুদিনের মধ্যে বিলুপ্ত হয়। টিকে থাকে আইয়ুববিরোধী কাউন্সিল মুসলিম লীগ।
দীর্ঘ কয়েক দশক পরে স্বাধীন বাংলাদেশে ড. কামাল হোসেন কি আইয়ুবের একই রাজনৈতিক কৌশল ধার করেছেন গণফোরামের বিলুপ্তি ঘটানোর জন্য? এবং এ ব্যাপারে নিজের গা বাঁচানো কি তাঁর উদ্দেশ্য? নইলে দেশে তাঁর দলেই একাধিক পরিচিত নেতা থাকতে তিনি বিদেশের এক অপরিচিত রাজনীতিক, এক রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীকে কেন তাঁর দলের শীর্ষ পদে তুলে দিলেন? তাঁর দল তো এমনিতেই এখন সাইনবোর্ডসর্বস্ব দল। এই সাইনবোর্ডও কি এখন তিনি ফেলে দিতে চান? বিদেশে জনরব, বিএনপির এক দল চায় তারেক রহমানের কবল থেকে বাঁচতে রুগ্ণ ও কারাবন্দি খালেদা জিয়াকে সরিয়ে ড. কামাল হোসেনকে বিএনপির নেতার পদে বসাতে। গুজবটি কি সত্য?


সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল হাজারী।   ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: গোলাম কিবরীয়া হাজারী বিটু্।   প্রকাশক: মোঃ ইব্রাহিম পাটোয়ারী।
সহ সম্পাদক- রুবেল হাসান: ০১৮৩২৯৯২৪১২।  বার্তা সম্পাদক : জসীম উদ্দিন : ০১৭২৪১২৭৫১৬।  সার্কুলেশন ম্যানেজার : আরিফ হোসেন জয়, মোবাইল ঃ ০১৮৪০০৯৮৫২১।  রিপোর্টার: ইফাত হোসেন চৌধুরী: ০১৬৭৭১৫০২৮৭।  রিপোর্টার: নাসির উদ্দিন হাজারী পিটু: ০১৯৭৮৭৬৯৭৪৭।  মফস্বল সম্পাদক: রাসেল: মোবা:০১৭১১০৩২২৪৭   প্রকাশক কর্তৃক ফ্ল্যাট নং- এস-১, জেএমসি টাওয়ার, বাড়ি নং-১৮, রোড নং-১৩ (নতুন), সোবহানবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং সিটি প্রেস, ইত্তেফাক ভবন, ১/আর কে মিশন রোড, ঢাকা-১২০৩ থেকে মুদ্রিত।  বার্তা, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ০২-৪১০২০০৬৪।  ই-মেইল : [email protected], web : www.hazarikapratidin.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি