শিরোনাম: |
কাশ্মীর ও বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে যে কারণে কিছু লিখিনি
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
|
ভারতের একটি ব্যবসায়ী দল এসেছেন লন্ডনে। এরকম হরহামেশা এসে থাকেন। এবার আগরতলার এক তরুণ সাংবাদিক এসেছেন। নাম পরেশ নাথ বৈদ্য। থাকেন কেরল রাজ্যে। ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। আসলে পরিচয় হয়েছিল তার বাবার সঙ্গে। এই পরিবারটি তখন বাস করত কলকাতার শেয়ালদায় ডিকসন লেনে।
এই ডিকসন লেনে আমিও তখন থাকি। ডিকসন লেনে কমিউনিস্ট পার্টির ‘দৈনিক স্বাধীনতা’র অফিস। ‘স্বাধীনতা’ নামের পত্রিকা তখন বন্ধ হয়ে গেছে; কিন্তু অফিসটি ছিল। এই অফিসেই প্রথম পরেশ নাথের বাবা হরনাথের সঙ্গে আমার পরিচয়। পরেশ নাথ তখন কিশোর। এই পরেশ নাথ বড় হয়েছেন। কলেজের মাস্টারি ছেড়ে কেরলের একটা ইংরেজি দৈনিকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এবং কেরলের একটি মেয়েকে বিয়ে করে কেরলেই থাকেন তা জানতাম। মাঝে মাঝে তার সঙ্গে চিঠিপত্রের আদান-প্রদানও ছিল। শুধু পরেশ নাথ বা তার পরিবারের কারও সঙ্গে সুদীর্ঘকাল দেখা-সাক্ষাৎ ঘটেনি। এই পরেশ নাথ দীর্ঘকাল পর লন্ডনে এসে আমার খোঁজ করবেন এবং খুঁজে বের করে এসে দেখা করবেন- তা ভাবতেও পারিনি। তাই তার দেখা পেয়ে চিন্তিত এবং আনন্দিত দুই-ই হয়েছি। পরেশ নাথই জানালেন, তিনি ব্যবসায়ী দলের সঙ্গে এসেছেন বটে; কিন্তু আসলে তিনি পার্টটাইম কলেজ শিক্ষক এবং পার্টটাইম সাংবাদিক। তার স্ত্রী সুদর্শনা, মাঝবয়সেও সত্যই সুদর্শনা। স্বামীর সঙ্গে এসেছেন। আমার স্ত্রী বেঁচে নেই জেনে পরেশ নাথ যথেষ্ট দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, খুবই আশা করেছিলাম, বৌদির হাতের রান্না খাব। কী করব, কপালে নেই। চা-পর্ব শেষ হল। এবার আলাপের সূত্রপাত। পরেশ নাথ বললেন, যদিও কেরলে থাকি; কিন্তু আপনার লেখা নিয়মিত পড়ার সুযোগ পাই। এটা অনলাইনের কল্যাণে। আপনার লেখা পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন মনে জেগেছে- কাশ্মীর সমস্যা এখন আবার একটি জীবন্ত সমস্যা হয়ে উঠেছে। এতদিন সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো ছিল। গত কয়েক বছরে মাঝে মাঝে আপনার লেখায় কাশ্মীর সমস্যার উল্লেখ পাই; কিন্তু সমস্যাটি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো আলোচনা দেখিনি। আপনি কি কাশ্মীর নিয়ে কিছুই লেখেননি? জবাব দিয়েছি, না কাশ্মীর নিয়ে কিছুই লিখিনি। এমনকি দিল্লির বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট যে রায় দিয়েছেন তা নিয়েও কিছু লিখিনি। বাবরি মসজিদ ভাঙার মামলায় ভারতের সুপ্রিমকোর্ট যে রায় দিয়েছেন, তা আমি সঠিক বলে মনে করি না। পরেশ নাথ বললেন, বলেন কী গাফ্ফার দা! একজন প্রগতিশীল মনের মানুষ হিসেবে আপনার কাছ থেকে এই ধরনের মনোভাব আশা করিনি। বললাম, প্রগতিশীল হলে কি কাশ্মীরে ভারতের বিশ্বাসভঙ্গের রাজনীতি এবং বাবরি মসজিদ ভাঙার ডাকাতদের হাতে মসজিদের জমি তুলে দেয়াকে সমর্থন জানাতে হবে? এই ব্যাপারে তোমার মনোভাবটা কী? পরেশ নাথ বললেন, কাশ্মীরে ভারতের সৈন্যের অত্যাচার, বিজেপি সরকারের কাশ্মীরকে ভাগ করার নীতি আমি সমর্থন করি না; কিন্তু এ কথা বিশ্বাস করি, শেরে কাশ্মীর শেখ আবদুল্লা তার রাজ্যের ভারতে যোগদান চূড়ান্ত করে গিয়েছিলেন। কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর বাবরি মসজিদ নিয়ে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট কী করতে পারত বলুন। মসজিদটা ভাঙা হয়ে গেছে। এটা এখন রিয়েলিটি। এই রিয়েলিটি অস্বীকার করতে গেলে ভারতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা হবে। এই রক্তপাত এড়াতেই সুপ্রিমকোর্ট বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির গড়ার জায়গা করে দিয়ে অন্যত্র বাবরি মসজিদ তৈরির জায়গা করে দিতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। পরেশ নাথকে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছি, কে আমাকে প্রগতিশীল ভাবলেন, প্রতিক্রিয়াশীল ভাবলেন, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। অত্যাচারিত কাশ্মীরিরা মুসলমান এবং আমিও মুসলমান, সে জন্য কাশ্মীরিদের সমর্থন করছি না। তারা নির্যাতিত মানুষ বলেই তাদের সমর্থন জানাই। কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ তা আমি বিশ্বাস করি না। কাশ্মীরের একাংশ ভারতের অধিকৃত এলাকা, অপর অংশ পাকিস্তানের অধিকৃত এলাকা। অধিকৃত এলাকায় অত্যাচার চালানোর কোনো অধিকার ভারত ও পাকিস্তানের নেই। এমনকি অধিকৃত কাশ্মীর ও জম্মুকে ভাগ করার যে নীতি বিজেপি সরকার গ্রহণ করেছে, তা-ও সমর্থনযোগ্য নয়, কাশ্মীরিদের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার রয়েছে একমাত্র কাশ্মীরিদের হাতে। বিজেপি সরকার কাশ্মীরে ইসরাইলের প্যালেস্টাইন নীতি অনুসরণ করছে। এই নীতি সাময়িক সাফল্য দেবে, স্থায়ী মীমাংসার পথ খুলবে না। পরেশ নাথ বললেন, তাহলে কাশ্মীরে যে সন্ত্রাস চলছে তা কি আপনি সমর্থন করেন? বললাম, মোটেও এই সন্ত্রাস সমর্থন করি না। এই সন্ত্রাস দ্বারা কাশ্মীরের মুক্তিও আসবে না। ভারত ভাগ হওয়ার সময় কাশ্মীরের নেতা শেখ আবদুল্লা চেয়েছিলেন তার দেশকে ভারত ও পাকিস্তানের বাইরে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন দেশ হিসেবে রাখতে। পাকিস্তানের দস্যুবৃত্তিতে তা তিনি পারেননি। পাকিস্তানের আকস্মিক হামলার মুখে তিনি শর্তসাপেক্ষে ভারতে যোগ দেন। এই শর্তগুলো ছিল : ভারতের মধ্যে কাশ্মীরের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকবে। কাশ্মীরের নিজস্ব সংবিধান ও পতাকা থাকবে। কাশ্মীরের সরকারপ্রধানকে মুখ্যমন্ত্রী নয়, প্রধানমন্ত্রী বলা হবে। ভারত এই শর্তগুলো মেনে নেয়ায় আবদুল্লা ভারতে যোগ দিয়েছিলেন। ভারতই প্রথম জাতিসংঘে যায় কাশ্মীর সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য। পরে নেহেরুই আবদুল্লার দেয়া শর্ত ভেঙে কাশ্মীরে সৈন্য মোতায়েন দ্বারা তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। কাশ্মীরের স্বতন্ত্র রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করে কাশ্মীরবাসীর সঙ্গে বিশ্বাস হন্তার রাজনীতি শুরু করেন। কাশ্মীরে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। এই গণবিক্ষোভ সন্ত্রাসে পরিণত হওয়ায় বিজেপি এখন সেখানে কার্যত সেনাশাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাশ্মীরিরা চেয়েছিল আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার। বন্দুকের শাসন ও নির্যাতন দ্বারা এই দাবি রুখতে গিয়ে প্রায় ভারতের কংগ্রেস এবং বিজেপি দুই সরকারই সেই অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদীদের কবলে ঠেলে দিয়েছে। পাকিস্তান এখন এই সন্ত্রাসের মদদদাতা। এই সন্ত্রাস যদি জয়ী হয়, তাহলে কাশ্মীর পাকিস্তানের অঙ্গীভূত একটি তালেবান রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এই আশঙ্কায় দেশ-বিদেশের অনেক প্রগতিশীল মানুষ কাশ্মীরিদের মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন দিতে পারছে না। কারণ, কাশ্মীরিদের মুক্তি সংগ্রাম বহিরাগত সন্ত্রাসী ও পাকিস্তানের পাঠানো এজেন্ট দ্বারা হাইজ্যাক হয়ে গেছে। এখন এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ জাতিসংঘের সেনাবাহিনী এই রাষ্ট্রটিতে মোতায়েন করা, সন্ত্রাসীদের বিতাড়ন করা, সাধারণ মানুষের ওপর ভারতীয় সৈন্যের অত্যাচার বন্ধ করা এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত একটি গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরিদের দ্বারা তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ব্যবস্থা করা। কাশ্মীরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গণভোট অনুষ্ঠানে নেহেরু রাজি হয়েছিলেন। পরে তিনি অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন। আমি মনে করি, কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের দখলদারিত্বের বিরোধ দূর হলে দুই দেশের সেনাবাহিনী যুক্তভাবে রাজ্যের জঙ্গিগোষ্ঠী ও সন্ত্রাসীদের দমনে জাতিসংঘকে সাহায্য করতে পারে। তাতে এই সন্ত্রাস দমন সহজ হবে এবং ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রের জন্য তা মঙ্গলজনক হবে। এখন প্রশ্ন হল বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? পরেশ নাথ ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনলেন; বললেন, আপনার কথাগুলো তো কাশ্মীরের ইজি মেড সমাধান। এখন বাবরি মসজিদ ভাঙার মামলায় ভারতের সুপ্রিমকোর্ট কী ভুলটা করেছে, তা বলুন। বলেছি, ভারতের সুপ্রিমকোর্টে ভুল করেছেন এমন কথা বলি না; কিন্তু একটি অনুচিত কাজ করেছেন। অন্যায়ভাবে সাতশ’ বছরের একটি পুরনো মসজিদ যারা ভেঙেছেন (এটা মন্দির বা গির্জা হলেও ভাঙা অপরাধ হতো), সেই অপরাধীদের কোনো শাস্তি দেয়া হয়নি। বরং অপরাধীদের হাতে মসজিদের জমি তুলে দেয়া হয়েছে। মসজিদের জন্য অন্যত্র জমি বরাদ্দ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোথায় সেই জমি এবং কতদিনে বরাদ্দ করতে হবে তা বলা হয়নি। এটা ভারতের সংখ্যালঘুদের অধিকার ভঙ্গ করা এবং ভারতের গণতান্ত্রিক সংবিধানের অবমাননা। পরেশ নাথ আমার কথায় সন্তুষ্ট হয়েছেন কী হননি, তা বোঝা গেল না। আগের মতোই আন্তরিক কণ্ঠে বললেন- কাশ্মীর সমস্যা ও বাবরি মসজিদ মামলার রায় সম্পর্কে আপনি আমাকে যা বললেন, তা আপনার কলামে লিখেছেন কি? তাকে বললাম, না, লিখিনি। কারণ, আমি ভারতের মতো গণতান্ত্রিক একটি বিরাট প্রতিবেশীর সঙ্গে বাংলাদেশের মৈত্রীতে ঘোর বিশ্বাসী। এই মৈত্রী গোটা উপমহাদেশেই স্থায়ী শান্তি ও সমৃদ্ধি ডেকে আনতে পারে। পাকিস্তান এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা বহুকাল চেষ্টা করেছে এই সম্পর্ক যাতে গড়ে উঠতে না পারে এবং তাদের আধিপত্য ও কায়েমি স্বার্থ যেন বজায় থাকে। এটা হাসিনা সরকারের অসামান্য কৃতিত্ব- সব বাধা-বিঘ্ন, চক্রান্ত ও অপপ্রচার ব্যর্থ করে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি অটুট মৈত্রী গড়ে তুলেছেন। ভারতে আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক নীতির বিরোধী একটি সাম্প্রদায়িক সরকার ক্ষমতায় আসার পরও দুই দেশের সেই সম্প্রীতি ও সহযোগিতা বেড়েছে বৈ কমেনি। কাশ্মীর ও বাবরি মসজিদ দুটিই ভারতের জন্য খুবই স্পর্শকাতর সমস্যা। এ সমস্যায় আর্ত মানবতাকে সমর্থনদান ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো স্বার্থ নেই। এ জন্যই ভেবেছিলাম, কাশ্মীর ও বাবরি মসজিদ সমস্যা আমাদের জন্য এমন কোনো জরুরি সমস্যা নয় যে, এখনই তা নিয়ে লিখতে হবে। এই লেখায় বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের কোনো ক্ষতি যেন না হয় সেটাও বিবেচনায় ছিল। পরেশ নাথকে বললাম, এখন মনে হয় সমস্যা দুটি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা দ্বারাই শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় সাহায্যদান সম্ভব। এই আলোচনায় ভারতের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিরক্ত হতে পারেন; কিন্তু ভারতের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ হতেন না। কারণ, তারাও কাশ্মীর অথবা ভারতের সংখ্যালঘু মানুষ অত্যাচারিত, নিপীড়িত হোক তা চান না। তাই অরুন্ধতী রায়ের মতো মুক্তবুদ্ধির লেখিকা, অপর্ণা সেনের মতো চিত্রাভিনেত্রীর কণ্ঠে কেবল নয়, ভারতের সুশীলসমাজের অনেকের কণ্ঠে প্রতিবাদের আওয়াজ উঠেছে। পরেশ নাথকে জিজ্ঞাসা করেছি, ভারতে ফিরে তিনি এই প্রতিবাদে শামিল হবেন কি না। পরেশ নাথ সুদর্শনার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। জবাব দেননি। |