শিরোনাম: |
মুজিব শতবর্ষ : ইতিহাসের আলোকে
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
|
অশোকবর্ষের কথা ইতিহাসে পড়েছিলাম। তা ছিল প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস। কোনোদিন ভাবিনি স্বাধীন বাংলাদেশে নিজে মুজিববর্ষে বাস করব এবং বর্ষটি দেখে যাব। আজ মুজিববর্ষ নিয়ে লিখতে বসে আমার বড় বেশি বন্ধু সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কথা মনে পড়ছে। দুরারোগ্য ক্যান্সারে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন। অশোকবর্ষের কথা ইতিহাসে পড়েছিলাম। তা ছিল প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস। কোনোদিন ভাবিনি স্বাধীন বাংলাদেশে নিজে মুজিববর্ষে বাস করব এবং বর্ষটি দেখে যাব। আজ মুজিববর্ষ নিয়ে লিখতে বসে আমার বড় বেশি বন্ধু সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কথা মনে পড়ছে। দুরারোগ্য ক্যান্সারে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘গাফ্ফার, আমার জন্য দোয়া করো, আমি যেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন দেখে যেতে পারি।’ তার এই শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। আমি অতি সৌভাগ্যবান। রোগজর্জরিত শরীরে এই মহামানবের মহাবর্ষটির উদযাপন দেখে যেতে পারলাম। ভারতবর্ষে কত সম্রাটই তো এলেন এবং গেলেন। কিন্তু দু’জন সম্রাটকে মানুষ এখনও মনে রেখেছে। একজন মগধের সম্রাট অশোক এবং আরেকজন দিল্লির সম্রাট আকবর। অশোক ও আকবরবর্ষ পালিত হয় না বটে, ইতিহাসে এই দুটি নাম স্মরণীয় হয়ে আছে।
সম্রাট অশোকের রাজদণ্ডের চক্র অশোকচক্র এখন স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতীক। পণ্ডিত নেহেরু বলেছেন, ‘আধুনিক ভারতীয় জাতির স্রষ্টা সম্রাট আকবর।’ কথাটা সঠিক। অশোক এবং আকবর দু’জনেই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। দু’জনেই শান্তি ও মৈত্রীর বার্তা প্রচার করে গেছেন। ব্রিটেনের একজন রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক টনি বেন (লর্ড ওয়েজউড বেন) লিখেছেন, ‘নেহেরু জিন্না দু’জনেই পশ্চিমা দেশে এসে পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, ব্রিটিশ সেকুলার রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতকে হিন্দু ভারত ও মুসলিম ভারতে ভাগ করেছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব বিদেশে এসে শিক্ষা লাভ না করেও দেশের মাটিতে বড় হয়ে উপমহাদেশে প্রথম একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তিনি শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, সমগ্র ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকার মতো নেতা।’ এই কথাটি যে কত সত্য, তার প্রমাণ, এককালে বিশ্বের মানুষ গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের নামে ভারতকে চিনত (এখনও চেনে)। এখন মুজিব বললেই সারা বিশ্বের মানুষ চেনে স্বাধীন বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ মানেই মুজিব। মুজিব মানেই বাংলাদেশ। আমার পরম সৌভাগ্য, আমি মুজিব যুগে জন্মেছি। তাকে চোখে দেখেছি। তার সাহচার্য পেয়েছি। এখন তার জন্মশতবার্ষিকী পালন করছি। আমার মতো সৌভাগ্যবান আর কতজন আছেন? প্রতি যুগে মহামানব জন্ম নেন না। যারা তার সাহচার্য পান তারা হলেন মহাসৌভাগ্যবান। এই অর্থে আমার মতো সৌভাগ্যবান কতজন বেঁচে আছেন। বঙ্গবন্ধু যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে বিচারাধীন, রাষ্ট্রপক্ষ তার মৃত্যুদণ্ড দাবি করছে, তখন তার ও অন্য অভিযুক্তদের বিচার চলাকালে দর্শক ও সাংবাদিকে আদালত কক্ষ ভরে যেত। বঙ্গবন্ধুকে আদালত কক্ষে আনা হলে তার পরিচিতজনদের অনেকে ভয়ে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন। ভয় ছিল যদি সরকারি গোয়েন্দারা বুঝতে পারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের পরিচয় আছে; তাহলে বিপদ হবে। সেজন্য তারা বঙ্গবন্ধুকে না চেনার ভান করতেন। প্রয়াত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একজন কাছের এবং প্রিয় সাংবাদিক। তিনি বঙ্গবন্ধুর বিচার চলাকালে ‘দৈনিক আজাদের’ রিপোর্টার ছিলেন এবং আদালতে আসতেন। তিনিও সরকারের চোখে ‘বিপজ্জনক সাংবাদিক’ ছিলেন। ফয়েজ আদালতে এসে বঙ্গবন্ধুর চোখাচোখি হতেন না। তা দেখে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু একদিন ফয়েজকে বলেছিলেন, ‘ফয়েজ, বাংলাদেশে বাস করিস, আর আমাকে এড়াবি তা হবে না। তা সম্ভব হবে না কারোর জন্যই।’ তার এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়েছে। বাংলার মানুষ কেন, বাংলার ইতিহাসও তাকে এড়াতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা যায় না। ১৯৫৫ সালে ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে আমিও গ্রেফতার হয়ে এক মাস ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিলাম। বঙ্গবন্ধুও এই সময় ঢাকা জেলে ছিলেন। সারাদিন জেল কক্ষে বন্দি থাকার পর বিকালে এক ঘণ্টার জন্য কক্ষের বাইরে মাঠে মুক্ত বায়ু সেবনের জন্য রাজনৈতিক বন্দিদের ছেড়ে দেয়া হতো। বঙ্গবন্ধুও মাঠে আসতেন। আমরা তাকে নিয়ে গোল হয়ে বসতাম। তিনি আমাদের খোঁজখবর নিতেন। তার পাশে বসে তার দরাজ কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতার আবৃত্তি শুনতাম। মাঝে মাঝে তিনি গাইতেন-‘কারার এই লৌহ কপাট, ভেঙে ফেল কররে লোপাট।’ ‘আমাদেরও তিনি গান গাইতে বলতেন, তখন কী আর জানতাম, জেলের ভেতরে যার পাশে বসে আছি, তিনি একদিন ইতিহাস স্রষ্টা মহামানব হবেন। যুগস্রষ্টা হবেন। একটি বর্ষ তার নামে পরিচিত হবে। ১৯৭৫ সালের জুন মাসের শেষদিক। আমি লন্ডনে ফিরে আসব। একদিন গণভবনে (পুরনো) তার সঙ্গে দেখা করতে গেছি। তিনি বাকশালের নতুন শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনে ব্যস্ত। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ হয়ে গেছে। চারদিকে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র। নানা গুজব। বঙ্গবন্ধু ধীরস্থিরভাবে তার আসনে বসে আছেন। একসময় মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘এধভভধৎ, ও যধাব পৎবধঃবফ ধ যরংঃড়ৎু. ও ধিহঃ াবৎু সঁপয ঃড় সধশব রঃ ধ ংঁপপবংং. ওভ ও ভধরষ, ও রিষষ মড় ঃড় ড়নষরারড়হ ভড়ৎ ধ ষড়হম ঃরসব.’ ইংরেজিতে তিনি কথা কটি বলেছিলেন, যার অর্থ ‘গাফফার, আমি একটি ইতিহাস তৈরি করেছি। তার সাফল্য আমি দেখে যেতে চাই। যদি এই সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হই, তাহলে আমি দীর্ঘদিনের জন্য বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাব।’ মহামানবের মুখের কথা কি বেঠিক হতে পারে? তাই ওই বছরেই তাকে হত্যা করে তার রচিত ইতিহাস মুছে ফেলার চক্রান্ত হয়েছিল। দীর্ঘ একুশ বছর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করা যেত না। হন্তারকের দলের নেত্রী তার মৃত্যু দিবসে নিজের বানানো জন্মদিবস মহাজাঁকজমকে উদযাপন করতেন। ইতিহাসের সেই মলিন অধ্যায় আজ আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কালো মেঘের আড়াল থেকে সত্যের সাহসী সূর্য বেরিয়ে এসেছে। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতার মহা আসনে অধিষ্ঠিত। গোটা বছরটি পালিত হচ্ছে মুজিববর্ষ হিসেবে। ইতিহাসে মুজিব যুগের একটি শাশ্বত অধ্যায় যুক্ত হয়েছে। তা আর কেউ কোনোদিন মুছে ফেলতে পারবে না। আমেরিকার বিশ্বময় প্রচারিত ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের কভারে ছবি ছাপা হওয়া এক সময় বিশ্বের নেতারা তাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবজনক ব্যাপার মনে করতেন। মিসরের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে একবার আনোয়ার সাদাতের ছবি টাইম ম্যাগাজিনের কভারে ছাপা হয়েছিল। তিনি আনন্দে উদ্বেল হয়ে ‘আল আহরাম’ দৈনিকের তখনকার বিখ্যাত সম্পাদক মোহাম্মদ হাইফেলকে ডেকে বলেছিলেন, দ্যাখো হাইফেল, আমি এখন নিজেকে মিসরের একজন ফেরাওঁ ভাবতে পারি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন চলছে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার জেলে, তখন সাপ্তাহিক টাইম ম্যাগাজিন বঙ্গবন্ধুর ছবি কভারে ছেপে তাকে নিয়ে কভার স্টোরি করেছিল। টাইমের সেই সংখ্যাটি সংরক্ষিত আছে লন্ডনে আমার এক আইরিশ বন্ধুর কাছে। সম্প্রতি তিনি আমাকে সংখ্যাটি দেখিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের ডি ভ্যালেরা আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। ব্রিটিশদের জেলের তালা ভেঙে পালিয়েছিলেন। টাইম তার ছবি ছাপেনি। বিশ্বের ক’জন মানুষ আজ তার নাম জানে? আর তোমাদের নেতা শেখ মুজিবের নাম জানে পৃথিবীর সব লোক।’ লন্ডনে আমার এক পরিচিত বাঙালি যুবক সাদেক তার বাড়ির সামনে বঙ্গবন্ধুর একটি আবক্ষ স্ট্যাচু প্রতিষ্ঠা করেছে। আমি বিস্মিত হয়ে দেখি, তার বাড়ির সামনে রোজ নানা দেশের হরেকরকম নর-নারীর ভিড়। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। লন্ডনে মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা, চার্চিলের লাইফ সাইজ মূর্তি আছে। তাতে রোজ এত লোকের ভিড় হয় না। আমি এই কথা লিখে গান্ধী বা নেলসনকে খাটো করছি না বা অশ্রদ্ধা দেখাচ্ছি না। তারাও বড় মাপের নেতা। আমার বলার কথা- বঙ্গবন্ধু আজ আর শুধু বাংলাদেশের নেতা নন, তিনি বিশ্বের নেতা, বিশ্ববন্ধু। ২০২০ সালটি একান্তভাবেই মুজিববর্ষ। উপমহাদেশে অশোকবর্ষের পর আর কোনো বর্ষ নেই। যুক্ত হল মুজিববর্ষ। আমাদের গর্বের ও গৌরবের সীমা নেই। |