শুক্রবার, ২৯ মার্চ, 2০২4
গুডবাই ইউরোপ, তারপর?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
Published : Sunday, 2 February, 2020 at 10:09 PM

৩১ জানুয়ারি মধ্যরাতে ইউরোপকে গুডবাই জানাল ব্রিটেন। এতদিন ব্রেক্সিট-প্রশ্নে দুই-দুইটি টোরি গভর্নমেন্টের (ডেভিড ক্যামেরন ও থেরেসা মে) পতনের পর বরিস জনসন নির্বাচনে জিতে ব্রিটেনকে ইউরোপিয় ইউনিয়ন থেকে সরিয়ে আনলেন। বরিস জনসনের যে বিতর্কিত পারিবারিক ও রাজনৈতিক জীবন, তাতে স্বাভাবিক অবস্থায় তার পক্ষে বিভক্ত টোরি পার্টিকে নিয়ে নির্বাচনে জয় এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়া দুরূহ ছিল।
কিন্তু আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ‘উগ্র জাতীয়তাবাদের ঘোড়ায়’ চড়ে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে সরে আসাটাকে ব্রাসেলসের কবল থেকে ব্রিটেনের স্বাধীনতা লাভ—এই প্রচার চালিয়ে বরিস কেল্লাফতে করেছেন; কিন্তু ব্রিটেনের মানুষের মধ্যে যখন বাস্তবতা বোধ ফিরে আসবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রিটিশদের মন থেকে ইউরোপ-ফোবিয়া চলে যাবে, তখন বরিস জনসনের হাল কী দাঁড়ায় তা দেখার রইল।
একশ্রেণির ব্রেক্সিটপন্থি লন্ডনের নাগরিক ৩১ জানুয়ারি মধ্যরাতে, অর্থাত্ ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার মুহূর্তে লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কোয়ারে উত্সবের আয়োজন করেছিল; কিন্তু সরকার বাস্তববুদ্ধির পরিচয় দিয়ে সেই উত্সবে মদ্যপান, লিভ মিউজিক ও ফায়ার ওয়ার্কস নিষিদ্ধ করে দেন। ফলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। ব্রেক্সিটবিরোধীরা এ উত্সবে কোনোপ্রকার বাধা দিতে যায়নি। আর ব্রেক্সিটপন্থিদের কাছে এই দিনটি ‘ধ ফধু ড়ভ হধঃরড়হধষ বসধহপরঢ়ধঃরড়হ (জাতির মুক্তি দিবস)’।
আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকা ফার্স্ট ধ্বনি তুলে, শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনায় সুড়সুড়ি দিয়ে হোয়াইট হাউজ দখল করেছেন। তাকে এ ব্যাপারে সাফল্য অর্জনে আপাতত সহযোগিতা জোগাচ্ছে আমেরিকার সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি। ব্রিটেনের তা নেই। ব্রিটেন এখন আর গ্লোবাল পাওয়ার নয়। তাকে ইউরোপ অথবা এশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতার ওপর বাঁচতে হয়। এক্ষেত্রে সাম্রাজ্য হারানোর পরও মুখ্যত সংখ্যাগরিষ্ঠ এশিয়ান দেশ নিয়ে ব্রিটিশ রানির নেতৃত্বে গঠিত কমনওয়েলথ ছিল ব্রিটেনের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির শেষ খুঁটি। স্কটল্যান্ড যুদ্ধেও ব্রিটেন জয়ী হয়েছে তাদের গোটা রেজিমেন্টের সাহায্যে।
টোরি এডওয়ার্ড হিথের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর মার্কিন মার্শাল প্ল্যানের সাহায্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠলেও ইউরোপে অতিরিক্ত মার্কিন খবরদারি অনেক ইউরোপীয় দেশের সহ্য হয়নি। তারা চেয়েছে স্বনির্ভর সামরিক শক্তি ও অর্থনীতি। এজন্য ডলারের বিশ্ব আধিপত্য রোধ করাতে ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য একই মুদ্রাব্যবস্থা ইউরো প্রচলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করেন, ব্রিটেন এ সময় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিয়ে তার হারানো সাম্রাজ্য শক্তির ক্ষতিপূরণ করতে পারবে এবং এই ইউনিয়নে নেতৃত্ব দিতে পারবে মনে করেছিল। এজন্য কমনওয়েলথের প্রতি আগ্রহ তারা হারিয়ে ফেলে এবং অনেক দরকষাকষির পর ইউনিয়নে যোগ দেয়। কিন্তু এই যোগদানটা ফুল ম্যারেজের রূপ নেয়নি। কয়েকটা বিষয়ে ব্রিটেন তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে চায়। ইউরোপের সঙ্গে ইউরোভিত্তিক একই মুদ্রাব্যবস্থায় না গিয়ে তারা নিজস্ব মুদ্রা পাউন্ড টিকিয়ে রাখে।
শুরু থেকেই ব্রিটেন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মিলন ছিল খণ্ডিত এবং দ্বিধাদ্বন্দ্বমূলক। ব্রাসেলস ব্যুরোক্রেসির কাছে ব্রিটেন তার স্বকীয়তা এবং পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিতে চায়নি। শোনা যায়, ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিতে অনিচ্ছুক না হলেও কমনওয়েলথকে গুরুত্বহীন করে ফেলায় দুঃখিত হয়েছিলেন। মার্গারেট থ্যাচার যখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী, তখন ইসির সঙ্গে তার খোঁচাখুঁচি প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। ইসির অনেক আইন ছিল ব্রিটিশ অনেক আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ব্রিটেন নিজেদের এই কতিপয় আইন বিসর্জন দিতে চায়নি। তার ওপর ইসি তহবিলে ব্রিটেনের দেয় চাঁদা এবং ব্রিটেনের পাওনা নিয়েও লন্ডন ও ব্রাসেলস্ মতানৈক্য দেখা দেয়। ইসি গঠনের শুরুতে আমেরিকা তাতে সমর্থন দেয়। ইউরোপে রাশিয়ান অভিযান ঠেকানোর নামে নাটো গঠিত হওয়ার পর ইসি হলে তা মস্কোর বিরুদ্ধে আরো ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা নেবে এটা ওয়াশিংটনের আশা ছিল। এজন্যে ব্রিটেনের ইসিতে যোগদান ও তাতে অবস্থানে সমর্থন জুগিয়েছে ওবামা প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত মার্কিন সরকার। কিন্তু জেনারেল দ্য গল ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ইউরোপে মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিরোধিতা এবং ইসিতে ব্রিটেনের চাইতে ফ্রান্সের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করার বিষয়টি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ইসি-বিরোধী করে তোলে। তিনি বরিস জনসনকে এবং তার ব্রেক্সিট নীতিকে সমর্থন জানান। ট্রাম্প ব্রিটেনকে আশ্বাস দেন, ইসি ত্যাগ করলে ব্রিটেনের যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষতি হবে সেটা আমেরিকা পুষিয়ে দেবে। এই আশ্বাস ব্রিটেনের ব্রেক্সিটপন্থি উগ্র জাতীয়তাবাদীদের উত্সাহ জোগায়। ব্রেক্সিটপন্থিদের যুক্তি, পূর্ব ইউরোপ থেকে বাঁধভাঙা ঢলের মতো বহিরাগত এসেছে এবং আসছে ব্রিটেনে। তারা ওয়েলফেয়ার স্টেটের সব বেনিফিট লুটছে এবং ব্রিটিশ অর্থনীতির ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রেক্সিট-বিরোধীরা বলেছেন, ব্রিটেনে ইউরোপিয়ান ইমিগ্রেশন ব্রিটিশ অর্থনীতির ক্ষতি করেনি, লাভ হয়েছে। ইউরোপের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া ব্রিটেন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমেরিকা এই ক্ষতিপূরণ করবে বলে আশ্বাস দিচ্ছে বটে, কিন্তু তা নিয়ে পরে এমন সব শর্ত আরোপ করবে যে তাতে ব্রিটেনকে সম্পূর্ণভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকে মার্কিন উপনিবেশ হতে হবে।
ব্রেক্সিট-বিরোধীদের এই আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তার প্রমাণ বরিস জনসন ট্রাম্পের সমর্থন পেলেও চীনের হুয়েওয়াই (ঐঁধধির) কম্যুনিকেশনকে ব্রিটেনে চালু রাখার ব্যাপারে ট্রাম্পের সঙ্গে তার মতান্তর দেখা দিয়েছে। ট্রাম্পের অভিযোগ, চীনের হুয়েওয়াই কম্যুনিকেশন আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের গোপন তথ্য চীনে পাচার করছে। এই অজুহাতে তিনি আমেরিকায় হুয়েওয়াইকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং চান পশ্চিমের সব দেশ তা করুক। বরিস জনসন তাতে রাজি হতে পারেননি। তার সরকার মনে করে, হুয়েওয়াইর বিকল্প ব্যবস্থা ব্রিটেনের ইনটেলিজেনস সার্ভিসের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে এবং এ ব্যাপারে আমেরিকার স্পাই এজেন্সির ওপর নির্ভরতা ঠিক হবে না। কারণ আমেরিকার বিশ্বস্ততার ওপর নির্ভর করা যায় না। ব্রেক্সিট হওয়ার পর ব্রিটেন কতটা মার্কিন আধিপত্য এড়াতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ব্রেক্সিটপন্থিদের অনেকেই উগ্র জাতীয়তাবাদী। ইসিতে যোগ দেওয়ায় ব্রিটেনের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হয়েছে, ব্রিটেনের রানি অথবা ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নয়, ব্রাসেলসের ব্যুরোক্র্যাটরা ব্রিটেন শাসন করছে এই ধরনের ধুয়া তুলে ব্রেক্সিটপন্থিরা গণভোটে সামান্য ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়। ব্রেক্সিটপন্থিদের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদ এতই প্রভাব বিস্তার করে যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এক ব্রেক্সিটবিরোধী মহিলা এমপিকে এক উগ্র ব্রেক্সিটপন্থি গুলি করে হত্যা করে। এখন ব্রিটেন সম্পূর্ণ একা। ইউরোপের সঙ্গে স্থলপথে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন এই ইউরোপিয়ান দেশটি অতীতে তার সাম্রাজ্যশক্তির জোরে গ্লোবাল পাওয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সাম্রাজ্য হারিয়ে ব্রিটেন এখন একটি ইউরোপীয় শক্তিমান। কমনওয়েলথের দিকে মুখ ফেরানো তার পক্ষে অসম্ভব।
এশিয়ান পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চীন ও ভারত। এশিয়ান মার্কেটে চীন ও ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সুযোগ ব্রিটেনের নেই। ব্রিটেন এখন ইসি ছাড়লেও ইউরোপের সঙ্গে একধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা তাকে গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় ট্রাম্প ব্রিটেনে মার্কিন আধিপত্য নিরঙ্কুশ করে তুলবেন।
ইতিপূর্বে ট্রাম্প ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (ঘঐঝ) অধিগ্রহণের প্রস্তাব তুলেছিলেন। তাতে সারা ব্রিটেনে প্রতিবাদ উঠেছে। এখন বরিস জনসন চাইলেও ইউরোপের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবেন তা মনে হয় না। তাকে ইসির সঙ্গে একধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হবে। সেটাই হবে ব্রিটেনের মঙ্গল এবং ইউরোপেরও মঙ্গল। 


সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল হাজারী।   ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: গোলাম কিবরীয়া হাজারী বিটু্।   প্রকাশক: মোঃ ইব্রাহিম পাটোয়ারী।
সহ সম্পাদক- রুবেল হাসান: ০১৮৩২৯৯২৪১২।  বার্তা সম্পাদক : জসীম উদ্দিন : ০১৭২৪১২৭৫১৬।  সার্কুলেশন ম্যানেজার : আরিফ হোসেন জয়, মোবাইল ঃ ০১৮৪০০৯৮৫২১।  রিপোর্টার: ইফাত হোসেন চৌধুরী: ০১৬৭৭১৫০২৮৭।  রিপোর্টার: নাসির উদ্দিন হাজারী পিটু: ০১৯৭৮৭৬৯৭৪৭।  মফস্বল সম্পাদক: রাসেল: মোবা:০১৭১১০৩২২৪৭   প্রকাশক কর্তৃক ফ্ল্যাট নং- এস-১, জেএমসি টাওয়ার, বাড়ি নং-১৮, রোড নং-১৩ (নতুন), সোবহানবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং সিটি প্রেস, ইত্তেফাক ভবন, ১/আর কে মিশন রোড, ঢাকা-১২০৩ থেকে মুদ্রিত।  বার্তা, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ০২-৪১০২০০৬৪।  ই-মেইল : [email protected], web : www.hazarikapratidin.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি