শুক্রবার, ২৯ মার্চ, 2০২4
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতল জলের ঘূর্ণিস্রোত
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
Published : Monday, 31 August, 2020 at 7:45 PM

একবার লসঅ্যাঞ্জেলেসের ষাট মাইল দূরে একটি নদী দেখতে গিয়েছিলাম। চমত্কার প্রাকৃতিক দৃশ্যঘেরা নদী। নদীটিও শান্ত। ঢেউ পর্যন্ত নেই। তরতর করে নদীটি বয়ে চলেছে। কিন্তু ঐ নদীর কাছে যাওয়ার কিংবা নদীটিতে স্নান করতে নামার ব্যাপারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ঐ নদীতে নামলে কেউ আর জীবিত উঠে আসে না। নদীটি দেখতে শান্ত। কিন্তু তার ভেতরে রয়েছে ভয়ানক ঘূর্ণিস্রোত, যা কিছু পায় ঐ ঘূর্ণিস্রোত তাকে অতলে তলিয়ে নেয়। ঢাকায় আমার যেসব বন্ধু সাংবাদিক আছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলছেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ওপর থেকে দেখতে খুবই শান্ত। কিন্তু তার নিচে অদৃশ্যভাবে ঘূর্ণিস্রোত বইছে। তাতে যে কোনো সময় যে কোনো অঘটন ঘটতে পারে। দেশের বাইরে বাস করি। তাই এই অদৃশ্য ঘূর্ণিস্রোত সম্পর্কে অবহিত থাকলেও তাকে খুব শক্তিশালী মনে হয়নি।

দুই দিন আগেও ঢাকার একটি দৈনিকে আমার কলামে লিখেছি, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ দল নানা অভিযোগের মুখোমুখি রয়েছে। কিন্তু হাসিনা-নেতৃত্ব স্থিতিশীল এবং তার কোনো বিকল্প এখনো দেখা দেয়নি। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শেখ হাসিনার ভারসাম্যের রাজনীতি সফল এবং ভারত ও চীন উভয় প্রতিবেশীর সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের ও সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবুল মোমেনও বলেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক এবং চীনের সঙ্গে রয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক।’ ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ব্যাপারে এর চাইতে ভালো বিশ্লেষণ আর কিছু হতে পারে না। কিছুদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব ঢাকা সফরে এসেছিলেন। তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ও করেছেন। উভয়ের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছে জানা যায়নি। বাজারে নানা গুজব ডালপালা ছড়িয়েছে। এই গুজবের একটি কথা ছিল, ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে যেন বাংলাদেশ বেশি আনুকূল্য না দেখায় সে জন্য শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানানো। এই গুজব কতটা সঠিক তা জানা যায়নি।

আমার ধারণা, ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের কোনো একটি আশু সমস্যা সম্পর্কে আলোচনার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। সেটি বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক হতে পারে। আবার করোনার ভ্যাকসিন-রাজনীতি সম্পর্কেও হতে পারে। করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি ও তা বাজারজাতকরণের ব্যাপারে আমেরিকা, চীন ও ভারতের মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে। বাংলাদেশ এই তিনটি দেশের ভ্যাকসিনই ট্রায়ালের জন্য আনার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে অথবা হচ্ছে। চীন এই ভ্যাকসিন দেবে ঋণ হিসেবে। ভারত দাম নেবে। আমেরিকা বিনা মূল্যে দেবে।

এই ভ্যাকসিন-রাজনীতিতে আমেরিকা এগিয়ে রয়েছে। অক্সফোর্ডেও মিলছে এই ভ্যাকসিন তৈরির গবেষণা। করোনা-ব্যাকসিন নিয়ে চীন ও ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশের জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ভারতের পররাষ্ট্রসচিব ঢাকায় এসেছিলেন মনে হয়। এটা নিয়ে গুজবের ঘুড়ি ওড়ানোর কোনো অবকাশ নেই। তথাপি গুজবের ঘুড়ি ওড়ানো হচ্ছে এবং ওড়ানো হচ্ছে বিএনপির একটি বিদেশি ঘাঁটি থেকে। এই ঘাঁটির অধীশ্বর তারেক রহমান। গুজবটি হলো, বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে নানা সহযোগিতা চুক্তি করায় ভারতের বিজেপি সরকার খুবই রুষ্ট। তাদের কূটনীতিকেরাও বাংলাদেশবিরোধী নানা উক্তি করেছেন। দিল্লির রাজনৈতিক মহলের খবর, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ যতটুকু সম্পর্ক তৈরি করেছে, তার প্রয়োজনীয়তা বিজেপি সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অনুধাবন করেন। এ সম্পর্কে তাদের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি নেই। চীন থেকে করোনার ভ্যাকসিন বাংলাদেশের আমদানি করা সম্পর্কেও দিল্লির কোনো মাথাব্যথা এখন পর্যন্ত নেই। গুজবটি অসত্য।

তাহলে বিএনপি ও তাদের মিত্রমহল থেকে এ ধরনের গুজব ছড়ানোর উদ্দেশ্য কী? এখানেই আসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ওপরের স্তরে শান্ত অবস্থার আড়ালে অদৃশ্য ঘূর্ণিস্রোতের অস্তিত্বের কথা। এই অদৃশ্য ঘূর্ণিস্রোত হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, যে ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য হাসিনা সরকারকে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করা এবং বাংলাদেশে আবার বিএনপি ও জামায়াতকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা। এই ষড়যন্ত্র সফল হলে কিছু জানা ও বোঝার আগেই আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ হবে এবং দেশপ্রেমিক সরকারি অফিসার, রাজনৈতিক দল ও নেতাকর্মীদের ওপর চলবে নিদারুণ অত্যাচার। বর্তমানের তথাকথিত সুশীল সমাজকে তখন মুখ বুজে থাকতে দেখা যাবে।

বাংলাদেশে এমন একটি রাজনৈতিক দৃশ্যের কথা কল্পনা করা অবাস্তব কিছু নয়। কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের দিন থেকেই শুরু হয়েছে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। ১৫ই আগস্টের সেনা উত্থান, বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাতীয় নেতাদের হত্যা—সবই ছিল সড়যন্ত্রের রাজনীতির ফসল। এটা এমন অতর্কিতে ঘটেছিল যে আওয়ামী লীগ দল ও সরকার কেউ এজন্য সতর্ক ও প্রস্তুত ছিল না। তখন যেমন ছিল দেশপ্রেমিক সরকারকে আকস্মিক আঘাত হানার ষড়যন্ত্র, বর্তমানেও তেমনি ষড়যন্ত্র চলছে। আগের ষড়যন্ত্রের চাইতে তার অবয়ব বড়, চেহারা দৃশ্যমান নয়।

বিএনপি ও জামায়াতকে বর্তমানে যতটা বিপর্যস্ত দল মনে করা হয়, তারা সংগঠন হিসাবে তা হতে পারে, কিন্তু ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে তারা হতবল নয়। জন্ম থেকে যেসব দল ষড়যন্ত্রের রাজনীতি দ্বারা ক্ষমতায় গেছে, তারা জনসমর্থনের তেমন পরোয়া করে না। রাজপথের রাজনীতি, মিটিং-মিছিল তাদের নয়। বর্তমানেও মন হতে পারে, ক্ষমতা ও জনসমর্থন হারিয়ে তারা নিষ্ক্রিয় ও হতবল, আদতে তারা তা মোটেই নয়। করোনা ভাইরাসের প্রতাপে কিছুকাল তারা নিষ্ক্রিয় থাকলেও কিছুদিনের মধ্যে আবার সক্রিয় হয়েছে এবং করোনা ভাইরাসকে তাদের মিত্র করে নিয়েছে।

জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব ফাঁসিতে গেলেও তাদের নিচু স্তরের সাংগঠনিক শক্তি অটুট রয়েছে। এখনো তারা মসজিদ ও দিনের সেবার নামে এবং এবার করোনা ভাইরাসকে দূর করার নামে বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসায় তাদের ঘাঁটি শক্ত করছে। আওয়ামী লীগের এখানে বেকুবের অবস্থা। এই অবস্থা সামলাতে তারাও টুপি মাথায় ধর্মীয় কাজে জামায়াতের সঙ্গে কাজ করছে। ব্যবসা-বাণিজ্যেও জামায়াতই এখন আওয়ামী লীগের একশ্রেণির বড় ব্যবসায়ীর আসল পার্টনার। জামায়াতের পার্টনার বিএনপির প্রকাশ্য রাজনীতি যতই ভেঙে পড়া অবস্থার হোক, তার ভূগর্ভস্থ ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এখনো সক্রিয়। তারেক রহমান এখনো বিপুল বৈভবের অধিকারী। এর ফলে তার বন্ধু বহু ব্রিটিশ এবং ভারতীয় রাজনীতিক ও কূটনীতিক। ব্রিটিশ লেবার পার্টির সাবেক নেতা ও প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন তারেকের গডফাদার বলে লন্ডনের বাজারেও গুজব। তারেক রহমান আগে প্রকাশ্যে লন্ডনে তার দলের সভা ডেকে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে টার্গেট করে বক্তৃতা করতেন। করোনার জন্য প্রকাশ্য জনসভা আগের মতো না করলেও তার ষড়যন্ত্রের রাজনীতি আরো ভয়ানক হয়ে উঠেছে বলে তার ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জানা যায়।

নানা গুজব ছড়িয়ে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চান এবং হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে ইচ্ছুক। তার লক্ষ্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া। এই উদ্দেশ্য পূরণে ঢাকা ও দিল্লিতে তার সমর্থকেরা সক্রিয়। ঢাকার সুশীল সমাজ এবং দিল্লির বিজেপি সমর্থক একদল রাজনীতিক ও কূটনীতিকের মধ্যে তারেকের এই অনুসারীরা রয়েছেন। তাদের কাজ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও বিরোধ সৃষ্টি করা এবং ভারত যাতে ঢাকার বর্তমান সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে তার ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ ক্রমশই চীনের দিকে ঝুঁকছে এবং ভারতের স্বার্থবিরোধী কাজ করছে, এটা মাঝেমধ্যেই তারা ভারতের কোনো কোনো মিডিয়ায় প্রকাশ করে। সম্প্রতি এই প্রচারণা আরো জোরদার করা হয়েছে।

এই প্রচারণা যদি বিজেপি সরকার, বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদিকে বিশ্বাস করানো যায়, সে জন্য তারেক রহমান অত্যন্ত তত্পর। একবার তারা যদি বিজেপির মৈত্রী অর্জন করে, তাহলে আজকের ভাঙা বিএনপিকে আবার জোড়া লাগতে দেখা যাবে এবং তারা বাঘের মতো হুংকার দিয়ে প্রকাশ্য রাজনীতিতে উঠে আসবে। যত দিন তা না হয়, তত দিন তারা রাজনীতির নদীর শান্ত উপরিভাগের নিচে হিংস্র ও ভয়াবহ ঘূর্ণিস্রোতের মতো ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে জড়িত থাকবে।

বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভারতের বিজেপি সরকার বাংলাদেশের বিএনপি-জামায়াত চক্রের এই ষড়যন্ত্রের জালে পা দেবে, তা আমি বিশ্বাস করি না। অনেকে বলেন, দেশে ’৭৫ সালের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। আমি তা-ও বিশ্বাস করি না। এটা ১৯৭৫ সাল নয়, ২০২০ সাল। তারেকের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে শেখ হাসিনা নিজে অবহিত এবং সতর্ক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামী লীগ নানা সমস্যায় জর্জরিত। দলটি যদি আবার সংগঠিত ও সংশোধিত হতে পারে, তাহলে বর্তমানের রাজনৈতিক ঘূর্ণিস্রোতকে ভয় করার কিছু নেই। গুজব, প্রচারণা ও ষড়যন্ত্র দ্বারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশলীতাকে ধ্বংস করা যাবে না। গণতন্ত্র এখন সতর্ক ও সাবধান।


সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল হাজারী।   ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: গোলাম কিবরীয়া হাজারী বিটু্।   প্রকাশক: মোঃ ইব্রাহিম পাটোয়ারী।
সহ সম্পাদক- রুবেল হাসান: ০১৮৩২৯৯২৪১২।  বার্তা সম্পাদক : জসীম উদ্দিন : ০১৭২৪১২৭৫১৬।  সার্কুলেশন ম্যানেজার : আরিফ হোসেন জয়, মোবাইল ঃ ০১৮৪০০৯৮৫২১।  রিপোর্টার: ইফাত হোসেন চৌধুরী: ০১৬৭৭১৫০২৮৭।  রিপোর্টার: নাসির উদ্দিন হাজারী পিটু: ০১৯৭৮৭৬৯৭৪৭।  মফস্বল সম্পাদক: রাসেল: মোবা:০১৭১১০৩২২৪৭   প্রকাশক কর্তৃক ফ্ল্যাট নং- এস-১, জেএমসি টাওয়ার, বাড়ি নং-১৮, রোড নং-১৩ (নতুন), সোবহানবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং সিটি প্রেস, ইত্তেফাক ভবন, ১/আর কে মিশন রোড, ঢাকা-১২০৩ থেকে মুদ্রিত।  বার্তা, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ০২-৪১০২০০৬৪।  ই-মেইল : [email protected], web : www.hazarikapratidin.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি