শিরোনাম: |
মুজিব-ভুট্টো বাহাস : ভুট্টোর পলায়ন
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
|
যুগান্তরে আমার ‘তৃতীয় মতের’ দু’জন পাঠক আমাকে অনুরোধ জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আমি দীর্ঘদিন ছিলাম, সুতরাং তার ব্যক্তিচরিত্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কোনো কাহিনী যদি লিখি, তাহলে তারা খুশি হবেন। তারা লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে আমরা তার রাজনীতির আদর্শ ও লক্ষ্য, তার স্বপ্ন ও রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে অনেক কথা জেনেছি, কিন্তু তার ব্যক্তিজীবনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না।
বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে ছিলেন এমন বহু মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আপনি এখনও বেঁচে আছেন। যদি বঙ্গবন্ধুর জীবনে কোনো একটি কাহিনীও আপনার তৃতীয় মতে আমাদের উপহার দেন আমরা খুশি হব।’ এই অনুরোধটি পেয়ে ভেবে দেখলাম, শোকের মাস আগস্ট চলে গেছে বটে; কিন্তু ২০২০ গোটা সালটাই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বছর হওয়ায় সারা বছরেই তার সম্পর্কে লেখা চলে। আমার অনেক পাঠকও তাই মনে করেন। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটি নাটকীয় ঘটনার কথা নিয়ে লেখা অপ্রাসঙ্গিক মনে করছি না। আজ থেকে ৫৪ বছর আগের কথা। ১৯৬৬ সাল। বঙ্গবন্ধু সদ্য তার ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেছেন। সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে ক্রোধ। অন্যদিকে উল্লাস। বাংলাদেশ তখন হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক শীর্ষ নেতা, এমনকি ফৌজি প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান ভয়ানক ক্রুদ্ধ। তিনি ছয় দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিযুক্ত করার ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর তোপ দাগছেন। অন্যদিকে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মধ্যে দারুণ উল্লাস। তারা ছয় দফাকে আখ্যা দিয়েছে বাঙালির মুক্তি সনদ-ম্যাগনা কার্টা। বাংলাদেশে বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ছয় দফার অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা এবং পাঞ্জাব ছাড়া সিন্ধু, বালুচ ও সীমান্ত প্রদেশের পাঠানদের মধ্যেও শেখ মুজিবের ছয় দফার প্রতি সমর্থন দেখে আইয়ুবের সামরিক জান্তা প্রমাদ গোনেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ছয় দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও রাষ্ট্রদ্রোহিতা আখ্যা দেয়ায় শেখ মুজিব ঢাকার হোটেল পূর্বাণীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, স্কটল্যান্ড গ্রেট ব্রিটেনের অন্তর্ভুক্ত দেশ। তাদের যদি স্বতন্ত্র পার্লামেন্ট, স্বতন্ত্র জাতীয় পতাকা, স্বতন্ত্র মুদ্রা (সহজ বিনিময়যোগ্য) থাকতে পারে, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দেড় হাজার মাইল দূরে অবস্থিত, স্থলপথে যোগাযোগবিহীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বতন্ত্র প্যারামিলিশিয়া, সহজ বিনিময়যোগ্য স্বতন্ত্র মুদ্রা এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রদেশের কর্তৃত্ব দাবি করা এমন কী অন্যায় করেছি? আমরা তো স্বতন্ত্র পার্লামেন্ট ও স্বতন্ত্র পতাকা চাইনি। সুতরাং আইয়ুব রাষ্ট্রদ্রোহিতা কোথায় পেলেন? বঙ্গবন্ধু আরও বললেন, ১৯৬৫ সালের ১৭ দিনের সেপ্টেম্বর-যুদ্ধে আমরা দেখেছি পূর্ব পাকিস্তান কতটা অরক্ষিত। পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত হলে তার ডিফেন্সের কোনো ব্যবস্থাই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা গড়ে তোলেনি। সেপ্টেম্বর-যুদ্ধে ভারত ইচ্ছা করলে বিনা বাধায় পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিত। কেবল নিরস্ত্র বাঙালি বাধা দিতে গিয়ে মরত। আমরা এ অবস্থা দেখতে চাই না। বর্তমান অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানকে তার নিজস্ব রক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতেই হবে। বঙ্গবন্ধুর (তখনও বঙ্গবন্ধু হননি) এই বক্তব্যে আইয়ুব রেজিম আরও তপ্ত হয়ে ওঠে। সম্ভবত তখনই তারা পূর্ব পাকিস্তানের একদল সামরিক ও বেসামরিক অফিসারকে বঙ্গবন্ধুসহ রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে গ্রেফতার করে ছয় দফা আন্দোলনকে নিকেশ করার প্ল্যান আঁটেন। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টোর ব্যক্তিগত সেক্রেটারির ডায়েরি প্রকাশিত হলে জানা যায়, ভুট্টো আইয়ুবকে বলেন, ‘মুজিব মাঝারি গোছের নেতা, জ্ঞানগম্যি কম, আমার সঙ্গে ইংরেজিতে তর্কযুদ্ধে পারবে না। প্রকাশ্য সভায় তাকে তর্কযুদ্ধে ডাকলে আমার সঙ্গে লড়াইয়ে নামতে ভয় পাবেন, আসবেন না। আর যদি আসেনও তর্কযুদ্ধে পরাজিত হলে তার সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মোহ কেটে যাবে। মোহ কাটবে ছয় দফা সম্পর্কেও।’ আইয়ুব এই নেতার কথায় আশ্বস্ত হননি। তার কনভেনশন লীগের অনেক নেতা, এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন গভর্নর মোনায়েম খাঁ ভুট্টো তর্কযুদ্ধে শেখ মুজিবকে হারাবেন তা বিশ্বাস করেননি। তবু আইয়ুব ভুট্টোকে একটা চান্স দিতে রাজি হন। ভুট্টো লাহোরের মাটিতে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিবকে ছয় দফা নিয়ে তার সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নামতে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মারেন। বলেন, আমি ঢাকায় এসে প্রকাশ্য জনসভায় ছয় দফা যে রাষ্ট্রদোহিতা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ-তা প্রমাণ করব। মুজিবের যদি সাহস থাকে তাহলে আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তর্কযুদ্ধে আসুন। এই খবরটি ঢাকা, লাহোর, করাচি ও পেশোয়ারের সব সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল। হেডিং ছিল, ‘ছয় দফা প্রশ্নে শেখ মুজিবকে ভুট্টোর চ্যালেঞ্জ : মুজিব চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার সাহস দেখাবেন কি?’ প্রশ্নটি ঢাকায়ও গুঞ্জন তুলেছিল। তখনকার চীনপন্থী এক বাম সাংবাদিকের সাপ্তাহিক ইংরেজি পত্রিকায় কটাক্ষ করে ইংরেজিতে যা লেখা হয়েছিল, তার বাংলা করলে অর্থ দাঁড়ায়: ‘ভুট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মুরোদ শেখ মুজিবের আছে কি?’ পুরানা পল্টনে আওয়ামী লীগ অফিসে দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে সাংবাদিকরা চেপে ধরল, শেখ মুজিব ভুট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন কি?’ তাজউদ্দীন কৌশলে প্রশ্নটির জবাব এড়িয়ে যান। ‘নেতা এলেই আপনারা জানতে পারবেন।’ একমাত্র ‘ইত্তেফাকের’ মোসাফির (মানিক মিয়া) তার রাজনৈতিক মঞ্চে লিখলেন, ‘শেখ মুজিব ভুট্টো সাহেবের মতো অক্সফোর্ড ডিকশনারি খুঁজিয়া ইংরেজি বলিতে না পারেন, শেক্সপিয়রের উদ্ধৃতি বক্তৃতায় যোগ করিতে না পারেন, কিন্তু তিনি ভুট্টোর চেয়ে অনেক সাহসী, দেশপ্রেমিক দক্ষ রাজনৈতিক নেতা। তিনি মন্ত্রিত্ব হারাইয়া ভুট্টো সাহেবের মতো চোখে রুমাল চাপিয়া কাঁদিবার লোক নন। তিনি সাহসী, জেল-জুলুম ভোগকারী দক্ষ নেতা। তিনি অবশ্যই ভুট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন। পল্টনের মাঠেই প্রমাণিত হইবে কে আসল নেতা এবং কে নকল নেতা।’ মানিক ভাইয়ের লেখার এটা হুবহু উদ্ধৃতি নয়। আমার স্মরণশক্তির ওপর নির্ভর করে যতটা পেরেছি উদ্ধৃত করেছি। ‘শেখ মুজিব সংবাদ সম্মেলনে দাঁড়িয়ে সবার সন্দেহ দূর করে ঘোষণা দেন: আমি ছয় দফার প্রশ্নে তর্কযুদ্ধে নামতে সম্মত হলাম। দিন-তারিখ ঠিক করে পল্টনের মাঠে প্রকাশ্য জনসভায় এই বিতর্ক হবে। ভুট্টো সাহেব তার দলবল নিয়ে ঢাকায় আসুন।’ পরবর্তী মাসের ৭ তারিখে (মাসের নামটি আমার স্মরণে নেই ’৬৬ সালের শেষদিকের কথা)। পল্টনের মাঠে এই জনসভার দিন ধার্য হল। ভুট্টো ঢাকায় আসতে রাজি হলেন। একটি বাংলা দৈনিক এই খবরের হেডিং দিয়েছিল: ‘ঢাকায় মুজিব-ভুট্টো বাহাস’। চারদিকে বিরাট সাড়া পড়ে গেল। পল্টনের মাঠে মঞ্চ তৈরি হল। বাহাস শুনতে মফস্বল থেকে দলে দলে লোক আসছে ঢাকায়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ডজনখানেক সাংবাদিক এসেছেন এই ঐতিহাসিক তর্কযুদ্ধের খবর স্ব স্ব পত্রিকায় পাঠানোর জন্য। পল্টনের অফিসে নেতার দেখা পেতেই উদ্বিগ্ন তাজউদ্দীন বললেন, ‘লিডার, আপনি ভুট্টোকে মোকাবেলার জন্য সত্যিই প্রস্তুত কি? ভুট্টো অক্সফোর্ডে ছাত্রজীবনে শেক্সপিয়রের ড্রামায় অভিনয় করতেন। নাটকীয়ভাবে শেক্সপিয়রের নাটকের অভিনেতার সাজে দর্শকদের মনভুলানো কথা বলে বাজিমাতের চেষ্টা করতে পারেন।’ আমি সেদিন আওয়ামী লীগের অফিসে উপস্থিত। বুকে দুরু দুরু ভাব। ভুট্টোর সঙ্গে মুজিব ভাই পারফরমেন্সে পেরে উঠবেন কি? তার পক্ষে যুক্তি যতই শক্তিশালী থাক, ভুট্টোর পারফরমেন্সের সামনে মুজিব ভাই দাঁড়াতে পারবেন কি? তাজউদ্দীন আহমদের কথায় মুজিব ভাই সেদিন হেসেছিলেন। ঠোঁট থেকে পাইপ সরিয়ে বলেছিলেন, ‘তাজউদ্দীন, সত্যের ওপর আস্থা রাখো। ভুট্টো খরগোশ হতে পারেন, আমি কচ্ছপ নই। আমি সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। সুতরাং আমি পরাজিত হব কেন? মিথ্যার বেসাতি যতই রংঢঙে হোক-তা টেকে না।’ সাত তারিখটি এগিয়ে এলো। ঢাকায় মহা উত্তেজনা। সভার সময় ছিল সকাল দশটা। শেখ মুজিব গায়ে মুজিব কোট চাপিয়ে হাতে পাইপ নিয়ে সভায় আসার জন্য প্রস্তুত। শোনা গেল ভুট্টোও সাজসজ্জা সেরেছেন। সভায় আসার জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু ঘড়িতে দশটা বাজে, সাড়ে দশটা বাজে তিনি আসছেন না। সবাই ভাবল, তার হয়তো সভায় পৌঁছতে দেরি হচ্ছে। এখনই এসে পৌঁছবেন। দুপুর বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে মুজিব ভাইকে খবরটা জানানো হল। ভুট্টোর হোটেলে খবর নিয়ে জানা গেল, তিনি এয়ারপোর্টে চলে গেছেন। লাহোরগামী দুপুরের ফ্লাইট ধরবেন। কাউকে কোনো খবর না দিয়েই তিনি ঢাকা ছেড়েছেন। মুজিব ভাইকে খবরটা জানানো হলে তিনি মৃদু হেসেছেন, কোনো মন্তব্য করেননি। ঢাকার একটি দৈনিক এই খবরের হেডিং করেছিল: ‘ভুট্টোর পলায়ন’। লাহোরের পাকিস্তান টাইমস মন্তব্য করেছেন, ‘ভুট্টো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যুদ্ধ না করেই পলায়ন দ্বারা নিজের মান খুইয়েছেন। মুজিব প্রমাণ করেছেন, তিনি ভুট্টোর চেয়ে অনেক বড় এবং সাহসী নেতা।’ আমার কথাটি এখানেই ফুরুলো। নটে গাছটি মুড়ুলো। |