শুক্রবার, ২৯ মার্চ, 2০২4
মৃত্যু উপত্যকায় মৃত্যুঞ্জয়ী আশাবাদ
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
Published : Saturday, 26 December, 2020 at 9:19 PM

মৃত্যু উপত্যকায় বাস করছি। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে জাগলেই মৃত্যুর খবর। আজ প্রায় এক বছর ধরে গোটা পৃথিবী মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। ব্রিটেনে এই মৃত্যুদূত আবার নতুন চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে। করোনাভাইরাসের চেয়েও এর শক্তি অনেক বেশি। প্রথম যখন কভিড-১৯-এর আবির্ভাব হয়, তখন চীনের উহান প্রদেশ থেকে তা এসেছিল বলে সবাই- বিশেষ করে আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন। এবার অভিযোগের আঙুল ব্রিটেনের দিকে।

কথায় বলে 'সুসময়ে বন্ধু বটে অনেকেই হয়/দুঃসময়ে হায় হায় কেহ কারো নয়।' ব্রিটেনেরও সুসময়ে বন্ধুর অভাব ছিল না। ধন, জন, বন্ধু, সাম্রাজ্য সবই ছিল এই 'লিটল ইংল্যান্ডের'। এখন কিছু নেই, কেউ নেই সঙ্গে। ব্রিটেনের নতুন ভাইরাসের দরুন ৪২টির বেশি দেশ তার সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইউরোপের সঙ্গে ব্রেক্সিট চেয়েছিলেন। এখন অটোম্যাটিক্যালি সেই ব্রেক্সিট হয়ে গেছে। ব্রিটেনের এখন বলতে গেল কমনওয়েলথ নেই, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও নেই। এককালে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্তমিত হতো না, সেখানে এখন সূর্যের দেখাই পাওয়া যায় না।

ব্রিটেনে এখন আমরা সাদাকালো বাদামি যারা বাস করি, তারা দিগন্তবিহীন সমুদ্রে সিন্দবাদের যুগের পিঠ উঁচু করে থাকা তিমি মাছের পিঠে সওয়ার হয়ে আছি। তিমি সমুদ্রে ডুব দিলে আমরা নেই। যতক্ষণ সে সমুদ্রপৃষ্ঠে পিঠ উঁচিয়ে রেখেছে, ততক্ষণই আমাদের অস্তিত্ব। আর তিমি সমুদ্রে পিঠ উঁচিয়ে থাকলেও তার পিঠে বসবাসকারী মানুষের খাদ্যের কী হবে? ব্রিটেনকে ছয় মাসের খাদ্য বিদেশ থেকে আমদানি করে বাঁচতে হয়। এবার নিউ টাইপের করোনা যদি সহসা তার উপদ্রব না কমায় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ব্রিটেনের সঙ্গে আবার যদি বিমান ও সমুদ্র যোগাযোগ শিগগিরই পুনঃস্থাপন না করে, তাহলে মহামারির সঙ্গে খাদ্য সংকটও কি ব্রিটেনের দেখা দেবে না?

ব্রিটেনের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা অনেক ভালো। বলেছেন, বিশ্বের বিশেষজ্ঞরা। ব্রিটেনের মতো বাংলাদেশ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সঙ্গে যোগাযোগহীন হয়ে পড়েনি। বাংলাদেশের এবারের খাদ্য উৎপাদনও আশানুরূপ। কভিড-১৯-এর সঙ্গে যুদ্ধের ব্যাপারেও বাংলাদেশ এখন একা নয়। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে, তাতেও নতুন ও পুরোনো করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুক্তভাবে যুদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে।

উহানের ভাইরাস যেমন দ্রুত সারাবিশ্বে ছড়িয়েছিল, তেমনই ব্রিটেনের নতুন এবং আরও শক্তিশালী ভাইরাসও যদি তার চেয়েও দ্রুত সর্বত্র ছড়ায়, তাহলে বিস্ময়ের কিছু নেই। আমেরিকার ফাইজার কোম্পানির ভ্যাকসিন সবার আগে ব্রিটেনে দেওয়া শুরু করে বরিস জনসন যে বাহবা কুড়ানোর আশা করেছিলেন, তা মাঠে মারা গেছে। ব্রিটেনের ফাইজারের ভ্যাকসিন জোরেশোরে দেওয়া শুরু না হতেই নতুন ভাইরাসের আবির্ভাব। ফলে লন্ডনসহ সব শহরেই লকডাউন দিতে হয়েছে। এবারের লকডাউনে কড়াকড়ি আরও বেশি। সবাই গৃহবন্দি থাকার অবস্থা। অস্ট্রিয়ার খবর, সেখানে পুরোনো ভাইরাসের প্রকোপেই লকডাউন করা হয়েছে, তার ওপর কারফিউ দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে।

আমেরিকার অবস্থাও ভালো নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের হঠকারিতার জন্য সারা আমেরিকাই এই মহামারিতে বিপর্যস্ত। বাইডেন নতুন প্রেসিডেন্ট হওয়ার ফলে এবং তিনি নতুন বিধি-ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে আমেরিকার মানুষের মনে আবার আশার আলো দেখা দিয়েছে। তবে ভ্যাকসিন এই বিশ্বময় মহামারি রোধে কতটা কার্যকর হবে, সে সম্পর্কে মানুষের মনে এখনও আস্থা তৈরি হয়নি। এই আস্থা তৈরি করা হলে মানুষের মনে সাহস ফিরে আসত। আর সাহসটাই হচ্ছে এই দানবের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

লন্ডনে করোনায় যারা মারা যাচ্ছে, তারা অধিকাংশই আমার কাছে বিদেশি এবং অপরিচিত। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে রোজই যাদের মৃতুর খবর পাই, তারা পরিচিত জন এবং অধিকাংশই আমার বন্ধু। ড. আনিসুজ্জামান থেকে আজ (২৪ ডিসেম্বর) যে আ. খ. ম. জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর খবর পেয়েছি, তিনিও ছিলেন আমার পরিচিত বন্ধুজন। কার জন্য কাঁদব? একজনের জন্য কান্নার অশ্রু না মুছতেই আরেকজনের মৃত্যুর খবর পাই। কারও একজনের জন্য কান্নার অবকাশ নেই।

সারা বিশ্বেই এই করোনায় যারা বাঁচবেন, তাদের মুখোমুখি হতে হবে এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার। এই মন্দা নাকি ত্রিশের মন্দার চেয়েও ভয়াবহ হবে। করোনায় যত লোক মারা গেছে তার প্রায় সমপরিমাণ লোক নাকি মারা যাবে এই মন্দায়। লাখ লাখ লোক বেকার হবে। শত শত কলকারখানা বন্ধ হবে। খাদ্যাভাব দেখা দেবে। ১৩৫০ (বাংলা) সালের দুর্ভিক্ষে এক বাংলাদেশেই ৫০ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। এবার বিশ্বব্যাপী খাদ্যাভাব দেখা দিলে কত লোক মারা যায়, তা কেউ অনুমান করতে পারছে না। তবে আশাবাদীরা বলছেন, অর্থনৈতিক মন্দার পদধ্বনি শুনে এবার বিশ্বের ধনী-গরিব সব দেশই নিজেদের সাধ্যমতো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করায় যত বড় আঘাতই আসুক, তা মোকাবিলা করার প্রস্তুতি থাকবে এবং আঘাত কিছুটা প্রতিহত করাও যাবে।

তবে একটা ব্যাপারে ইউরোপ-এশিয়ার বিশেষজ্ঞরা সহমত পোষণ করেন যে, বিশ্বে বড় বড় দুর্ভিক্ষ-মহামারির পরই সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব ও রূপান্তর ঘটতে দেখা গেছে। এই বিপ্লব ঠেকানো অসম্ভব। উদাহরণ- প্রথম মহাযুদ্ধের পর বিজয়ী শক্তির অত্যাচার ও শোষণে জার্মানিতে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং বহুলোক মারা যায়। অনাহারী মানুষের মনে ক্ষোভ দেখা দেয়। এই ক্ষোভে হিন্ডেনবার্গের দুর্বল গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটে। হিটলার ও নাৎসিবাদের অভ্যুদয় ঘটে। শুরু হয় ইহুদি-হত্যা। জার্মানির সামাজিক ব্যবস্থাতে বিরাট পরিবর্তন ঘটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের সর্বনাশা কূটবুদ্ধিতে ১৩৫০ বঙ্গাব্দে অবিভক্ত বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ও মহামারি দেখা দেয়। লোকক্ষয় হয় প্রচুর। এই দুর্ভিক্ষ-মহামারির পটভূমি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের শুরু। ব্রিটিশদের ভারত ছাড়তে হয়। ফলে দেখা দেয় দেশটির রাজনৈতিক বিভাজন এবং সামাজিক পরিবর্তন। বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকরা ভাবছেন, এবারের বিশ্বব্যাপী মহামারি ও মন্দার পর যদি কোনো রাজনৈতিক বিপ্লব ও সামাজিক পরিবর্তন ঘটে, তাও হবে বিশ্বব্যাপী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী ঘটনা সামন্তবাদের সম্পূর্ণ বিলোপ। এবারের মহামারি ও মন্দার ঘটনা কি বিশ্ব ধনবাদের অবসান ঘটাবে? এতটা আশা কেউ করেন না। তবে বিশ্ব ধনবাদের চেহারা ও নেতৃত্ব যে পাল্টাবে, এ ব্যাপারে অনেকেই সুনিশ্চিত। ট্রাম্প মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে গেছেন। এখন ভবিষ্যতের সংশোধিত গণতান্ত্রিক ধনবাদের নেতৃত্ব কার হাতে যাবে? যারা ভাবছিলেন চীনের হাতে যাবে, তাদের অনেকে মত পাল্টে বলছেন, ভারত অথবা ব্রাজিলের হাতে যেতে পারে। রাষ্ট্রবিপ্লবের ক্ষেত্রে করোনা ও অর্থনৈতিক মন্দা চীনে একনায়কত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটাতে পারে। ঘটতে পারে দ্বিতীয় আরব বসন্তের মতো ঘটনা সৌদি আরব, জর্ডানের মতো রাজতন্ত্রী দেশগুলোতে। আরব দেশগুলোর রাজা ও ডিক্টেটরদের সঙ্গে ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় মৈত্রী স্থাপন করে ইসরায়েল যতটা উল্লসিত, সেই উল্লাস বেশিদিন টিকতে নাও পারে। আরব জনগণের মধ্যে জাগরণ ঘটবে। সারা আরব বিশ্ব নির্যাতিত ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়াতে পারে।

এবার বিশ্বে সুপার পাওয়ার আধিপত্যের অবসান হবে। করোনার মতো খালি চোখে অদৃশ্য জীবাণুর কাছে আমেরিকার সর্বশক্তির মারণাস্ত্র কত অসহায়, এবার তা দেখা গেল। ট্রাম্প সাহেব হুমকি দিয়ে করোনাভাইরাসকে কিছু মাত্র ভয় দেখাতে পারেননি। বরং করোনার নির্দেশ মতে মুখে মাস্ক না পরে এবং করোনাকে 'সামান্য ফ্লু' বলে ঠাট্টা করতে গিয়ে নিজে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং মাস্ক পরতেও বাধ্য হয়েছেন। ব্রিটেনের রাজপরিবার করোনার ভয়ে মুখে মাস্ক পরেছে এবং ভালো মানুষের মতো সোশ্যাল আইসোলেশন মেনে চলছে।

অর্থাৎ প্রতাপ ও আধিপত্য কাকে বলে করোনা তা দেখাচ্ছে। করোনার বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে আমেরিকা, রাশিয়াসহ সব দেশ। রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে বিশ্বের হাজারো বিজ্ঞানী করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ভ্যাকসিন তৈরিতে ব্যস্ত। কোথায় গেল মানুষের ধর্মীয় উৎসব, সামাজিক উৎসব? করোনার ভয়ে সব এখন মুলতবি।

গোটা বিশ্ব এখন মৃত্যু উপত্যকা। এই মৃত্যু উপত্যকায় বাস করে ভাবছি আমি নিজে বাঁচব তো! বন্ধু-বান্ধব সবাই তো চলে গেছেন। এই আশি ঊর্ধ্ব বয়সে বেঁচে থাকাটা আমার নিজের কাছেই বিস্ময়। তবু আশাবাদীদের দলে থাকতে চাই। ইতিহাসের আগের যুগে মানবতা যেমন ডাইনোসোরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে রয়েছে, মৃত্যু-ব্যবসায়ী গ্লোবাল ক্যাপিটালের মারণাস্ত্রের মধ্যেও বেঁচে রয়েছে, তাহলে এই করোনা মহামারির ভয়ংকর থাবা থেকেও বাঁচবে না কেন? মানবতার মৃত্যু নেই, মানবতা অপরাজেয়।


সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল হাজারী।   ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: গোলাম কিবরীয়া হাজারী বিটু্।   প্রকাশক: মোঃ ইব্রাহিম পাটোয়ারী।
সহ সম্পাদক- রুবেল হাসান: ০১৮৩২৯৯২৪১২।  বার্তা সম্পাদক : জসীম উদ্দিন : ০১৭২৪১২৭৫১৬।  সার্কুলেশন ম্যানেজার : আরিফ হোসেন জয়, মোবাইল ঃ ০১৮৪০০৯৮৫২১।  রিপোর্টার: ইফাত হোসেন চৌধুরী: ০১৬৭৭১৫০২৮৭।  রিপোর্টার: নাসির উদ্দিন হাজারী পিটু: ০১৯৭৮৭৬৯৭৪৭।  মফস্বল সম্পাদক: রাসেল: মোবা:০১৭১১০৩২২৪৭   প্রকাশক কর্তৃক ফ্ল্যাট নং- এস-১, জেএমসি টাওয়ার, বাড়ি নং-১৮, রোড নং-১৩ (নতুন), সোবহানবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং সিটি প্রেস, ইত্তেফাক ভবন, ১/আর কে মিশন রোড, ঢাকা-১২০৩ থেকে মুদ্রিত।  বার্তা, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ০২-৪১০২০০৬৪।  ই-মেইল : [email protected], web : www.hazarikapratidin.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি